ইংল্যান্ডের এক শহরের দুই গল্প [১] : হুসনুন নাহার নার্গিস
সিটি একটা কিন্তু তার দুটি গল্প। ১৮৭৭ সাল। রানী ভিক্টোরিয়ার জমজমাট গোল্ডেন জুবিলী উৎসবের তোড়জোড় চলছে।
ট্রাফালগার স্কোয়ার ধুয়ে—মুছে পরিষ্কার করতে হবে। কারণ সেখান দিয়ে যাবে রানী ভিক্টোরিয়ার ঘোড়ার গাড়ীবহর। হাজার হাজার লোক জড়ো হবে সেখানে। রাস্তার দুই পাশে লাইন দিয়ে দাঁড়াবে জনতা।
রানী তখন টিনএজ গার্ল। মাত্র কদিন আগে তার মাথায় পরানো হয়েছে রানীর মুকুটÑঅর্থাৎ রানী হিসেবে সিংহাসনে সবে বসেছেন তিনি। চারদিকে সাজ সাজ রব। ওয়েস্ট এন্ডের বিরাট বিরাট অট্টালিকার জানালা—দরজা লাল—নীল রঙে রঙ্গিন করা হয়। ফুলের মালা আর ইলেকট্রিক লাইট দিয়ে সাজানো হয় রাস্তা ঘাট।
এর পঞ্চাশ বছর পরেই ভিক্টোরিয়া একে একে ইউরোপের ‘রয়্যাল হেড’ আর ‘ভারতবর্ষের প্রিন্সেস’ উপাধি পান। তার দীর্ঘ শাসন আমলে ব্রিটেনের অর্থনীতি তুঙ্গে ওঠে। তার সময়ে ‘ব্রিটিশ রাজত্বে সূর্য অস্ত যায় না’ বলা হতো। কারণ পৃথিবী জুড়ে বিরাট তার রাজত্ব। এর অর্থ পৃথিবী জুড়ে রানী ভিক্টোরিয়া এবং তার রাজত্ব। এ গল্পে লন্ডনকে দেখানো হয় শক্তিশালী রাজ্যের সবচেয়ে ধনী শহর হিসেবে।
এই হলো লন্ডনের একদিকের গল্প। অন্যদিকের গল্প লন্ডনের ‘ইস্ট এন্ডের’। যে গল্প খুব কম মানুষই জানে। দুষ্টু ক্ষত ঢেকে রাখাই ভালো, তাই নয় কি? এই গল্পে মানুষকে মানুষ বলে গণ্য করা হয় না। তাদের দেখাশুনার কেউ নেই। তাদের কথা শুনারও কেউ নেই।
কী সেই গল্প? দরিদ্রপীড়িত মানুষের সেই গল্প। দরিদ্রমানুষ কেন এখানে এসেছে, তাদেরকে কারা নিয়ে এসেছে এখানে? সেই কাহিনী নিয়েই এই গল্প।
হোয়াইট চ্যাপেলÑযা ছিল সেই সময় লন্ডন শহরের সীমানার বাইরে। ইন্ডাস্ট্রিয়াল রেভুলেসানের পর সেখানে অনেক ইন্ডাস্ট্রি গড়ে উঠে। সেসব ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করার জন্য গ্রাম থেকে শত শত বেকার মানুষ হোয়াইট চ্যাপেলে এসে হাজির হয়। ইন্ডাস্ট্রির মালিকরা তাদের থাকার জন্য অল্প দামের ম্যাটেরিয়াল দিয়ে ছোটো ছোটো খুপরি বানিয়ে দেয়। যাকে বলা হয় স্লাম বা বস্তি। কিছু কিছু লম্বা বাড়ি থাকলেও প্রতিটি ঘরে এক—একটি পরিবার কোনো মতে মাথাগুঁজে বাস করত। সে সময় মেয়েদের গৃহিণী হিসেবেই দেখা হতো । স্বামী ইনকাম করত আর স্ত্রী ঘর—সংসার সামলাতো।
দাম্পত্য জীবনে কোনো কারণে ফাঁটল ধরে সংসার ভেঙে গেলে নারী অসহায় হয়ে পড়তো। ইনকামের মানুষটি যদি না থাকে কে ভরন—পোষণ চালাবে? বাচ্চাকাচ্চারইবা কী হবে ? সন্তান থাকলে মেয়েটিকে আরও বেশি সমস্যায় পড়তে হতো। নিজের সন্তানকে নিয়ে মেয়েটিকে তখন রাস্তায় নামতে হতো। সেসব অসহায় মেয়েগুলোর শেষ ঠিকানা হতো এই ইস্ট লন্ডনের ‘কফিন বেড’; যার ভাড়া চার পেন্স প্রতি রাত। চার পেনি দিতে পারলে থাকো, না—হলে রাস্তায় বেঞ্চে, অলিগলি বা চিপায়—চাপায় শুয়ে পড়ো। এই রাস্তায় থাকা মেয়েদের কী বিপদ হতে পারে তা সবারই জানা।
১৮৮৮ সাল। এই সময়ে এখানে কয়েক দিন পর পর পাঁচজন নারী মার্ডার হতে থাকে। পাঁচ নারী তাদের জীবন আরম্ভ হয় বিভিন্ন স্থানে। কিন্তু ভাগ্য তাদের নিয়ে আসে লন্ডনের ইস্ট লন্ডনে। তারা ভিন্ন হলেও এক জায়গায় তাদের মিল আর সেই মিল হলো তাদেরকে হত্যা করে মারা হয় আর হত্যা করে সেই একজন মানুষইÑজ্যাক দি রিপার। কে সেই জ্যাক দি রিপার? তার পরিচয় এখনো নিশ্চিত নয়। রিপারের নাম দিয়ে চিঠি লিখে স্টার পত্রিকার রিপোটার্র, যেন লিখছে সেই খুনি নিজে। আসলে তা ছিল বানানো। খুনির একটা চিঠি পোস্টে এসে সেটাই ছাপা হলো পত্রিকায়। এটা পড়ার জন্য অনেক মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়ে। পেপার বেশি বিক্রি হবেÑএই ছিল প্ল্যান। এটা ছিল এডিটরের নির্দেশ।
ভিক্টোরিয়ান আমলে ওয়েলফেয়ার সিস্টেম ছিল না। স্কুল বাধ্যতামূলক হয়নি। তবুও আগের শতকের তুলনায় মানুষের অক্ষরজ্ঞান কিছুটা বৃদ্ধি হচ্ছিল। সেই অল্প পড়াশুনা জানা মানুষের জন্যই ট্যাবলয়েড পত্রিকা। পত্রিকাগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতা ছিল কীভাবে রমরমা খবর ছাপিয়ে সেই মানুষগুলোকে টার্গেট করা যায় পাঠক হিসেবে। শুধুমাত্র পেপার বিক্রির জন্য হত্যার রমরমা গল্প প্রকাশ করা হতো। কে কে সাক্ষী দিয়েছে, কী দেখেছে, কী বীভৎস সেই হত্যাকাণ্ড ইত্যাদি ইত্যাদি।
‘ঞযব ঝঃধৎ’ সে সময়ের সেই রকমই একটি ট্যাবলয়েড পত্রিকা। চার্লস ওয়ারেন ছিল এর ইনভেস্টার এবং ফ্রেড বেস্ট জার্নালিস্ট রিপোর্টার। ফ্রেড বেস্ট রিপোর্টার—এর হাতে লেখা লাল অক্ষরে চিঠিই ছিল সেই 'জ্যাক দি রিপারের' চিঠি।
পরবর্তীতে ইতিহাসবিদরা অনুসন্ধান চালিয়ে এসব তথ্য খুঁজে পান। ইতিহাসবিদরা বলে গেছেন এই মেয়েগুলো ‘ÔThey never received justiceÕ’।
স্থানটিতে ছিল দরিদ্র মানুষের বসবাস। তাই হত্যা, চুরি, ছিনতাইÑএগুলো ছিল প্রতিদিনের সাধারণ ব্যাপার। একদিকে ব্রিটেনের ধনী লোকের বসবাস, আর একদিকে এই মানুষ নামের কীটের বাস। তাদেরকে দেখাশুনার জন্য যেন সরকার নয়। সরকার শুধু মাত্র ধনীদের জন্য।
"A country of two nations: two nations between whom there is no intercourse and no sympathy , who are ignorant, as if they were dwellers in different zones or inhabitants of different planets, who are formed by different breeding, are fed by different food, are ordered by different manners, and are not governed by the same laws.. The RICH and The POOR. Benjamin Disraeli. 1845
এই পাঁচটি মেয়েকে পুরুষ—শাসিত নিউজ পেপার মালিক নিজেদের পেপার যাতে বেশি বেশি বিক্রি হয় তাই মনগড়া রিপোর্ট লিখে বিক্রি করতো। তারা কেউই পতিতা ছিল না, তবু তাদেরকে পতিতা বলে প্রচার করা হতো। তাদের হয়ে বলার কেউ ছিল না।
এই পাঁচ নারীকে নিয়ে খবরের কাগজের মালিক রসকষ লাগিয়ে যেমন ইচ্ছা তেমন রিপোর্ট লিখে কাগজ যাতে বেশি বিক্রি হয় তার প্রতিযোগিতায় নেমেছিল। উদ্দেশ্য মুনাফা অর্জন। সেই অভাগা, অসহায়, ক্ষুধার্ত আশ্রয়হীন মেয়েগুলোর জন্য কিন্তু তাদের বা সেই তথাকথিত ধনী মানুষদের কোনো মাথা ব্যথ্যা ছিল না।
এই পাঁচ নারী হচ্ছে: পলি নিকল, অ্যানি, এলিজাবেথ, ক্যাথরিন এবং মেরি জেন কেলি। যারা টাকার অভাবে রাস্তায় ফুটপাতে ঘুমাতে বাধ্য হয়েছিল আর সেখানেই তাদেরকে খুন করা হয়। হত্যাকাণ্ডের এই খবরকে রিপোর্টার খবর টিকে রসালো করার জন্য লাগিয়ে দেয়া হয় ভিকটিমরা সবাই ছিল পতিতা! এই পাঁচ নারী তখনকার সময়ের সমাজের প্রতিচ্ছবি।
এই পাঁচ নারী কারোর মেয়ে, কারোর বোন, কারোর স্ত্রী বা মা। সর্বোপরি তারা মানুষ। সে সময়ে 'মানুষ' বলতে শুধু পুরুষকেই বুঝাতো হতো। মেয়ে মানুষ আবার মানুষ হয় নাকি—এই ছিল তখনকার কথা।
সেই পরিচয় গুলো নিয়ে কেউ চিন্তা করে না।
এক শহর তার দুই গল্প আর এই লন্ডন শহরের হোয়াইট চ্যাপেল বা ইস্ট লন্ডনের আরও ইতিহাস আছে।
আর তা হলো এখানে বিভিন্ন সময়ে জীবিকার সন্ধানে আসে অন্য দেশ থেকে আসা মানুষ। সবার আগে আগে এসেছে ফ্রান্স থেকে, তারপরে ক্রমান্বয়ে আয়ারল্যান্ড, 'জু' কমিউনিটি এবং সর্বশেষে বাংলাদেশী।
বাংলাদেশী মানুষ ব্রিটেনে আসে ১৯৪৫ সালের দিকে। অবশ্য খুব অল্পসংখ্যক বাংলাদেশী তার আগেও এসেছিল জাহাজের কর্মচারী হিসেবে। জাহাজ থেকে নেমে তারা থেকে যায়। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পরে বিধ্বস্ত ঘরবাড়ি ঠিক করা এবং কলকারখানায় কাজের জন্য শ্রমিকের দরকার পড়ে। তখন বাংলাদেশ বলে কিছু ছিল না। ভারত ছিল তাদের কলোনি। প্লেনের ভাড়া দিয়ে সে সময় বাংলাদেশ থেকে মানুষ নিয়ে আসা হতো। ফ্রান্স থেকে আগত মানুষজন এখানে সিল্ক বুননের কাজ করত, দুর্ভিক্ষপীড়িত ছিল আইরিস, জু কমিউনিটি চামড়ার জুতো তৈরি আর বাংলাদেশীরা রেস্টুরেন্ট বিজিনেস। অবশ্য প্রথম দিকে তারা কারখানায় শ্রমিক ছিল।
যারাই এখানে থাকুক না কেন প্রথম দিকে কঠোর পরিশ্রম করে তারপরে টাকা জমিয়ে বাড়ি কিনে এখান থেকে দূরে চলে যায়। জ্যাক দি রিপার, বস্তি, দরিদ্র আর মাইগ্রেন্ট করা মানুষ এদের নিয়েই হোয়াইট চ্যাপেল। এই ছিল ভিক্টোরিয়ান ব্রিটেনের ইস্ট লন্ডনের গল্প।
--চলবে
নারী ও শিশুবিষয়ক কর্মী, লন্ডন