।। হিমাদ্রি বড়ুয়া ।।
এই আসছে আসছে করতে করতে দুর্গাপূজা এসেই গেল। হাতে সময় নেই বললেই চলে।
আসন্ন পুজো নিয়ে রাধারাণীর মন খুবই অধীর ঘরের কাজ নিয়ে। শ্বশুর-শাশুরীর রেখে যাওয়া এক চালা টিনের এই মাটির ঘরটি তার কাছে যেন একচিলতে স্বর্গ! বিল থেকে নতুন মাটি এনে দুদিন ধরে ঘরটিকে লেপে-মুছে আজ কিছুটা ক্লান্ত সে।
বলরাম কিছুক্ষণ আগে দুপুরের ভাত খেয়ে শুয়ে আছে বিছানায়, রাধারাণীও তার পাশে শুয়ে আছে।
কেউই ঘুমায়নি; অথচ দুজনই নীরব!
একপর্যায়ে বলরামের দিকে পাশ ফিরে তার অনেকদিন ধরে না কাটা চুলে আলতো ছোঁয়ায় হাত বুলাতে বুলাতে রাধারাণী বলে, নিবারন কাকাকে ডেকে এনে টিনের চালের ছিদ্রগুলো তো মেরামত করা দরকার, বৃষ্টি পড়লে কী অবস্থা হয় তুমি তো সব জানো। আমার কাছে কিছু টাকা জমানো আছে, ওগুলো দিয়ে হয়ে যাবে হয়ত!
বলরাম কোনো রকম জবাব না দিয়ে হুঁ-হাঁ করে পাশ ফিরে শোয়!
বলরামের এমন তাচ্ছিল্যে রাধারাণীর অভিমান হয়, আর কোনো কথা না বাড়িয়ে বিছানা ছেড়ে ঘরের কাজে মন দেয় সে।
এদিকে রাধারাণীর এমন অভিমানে বিছানা ছেড়ে উঠে যাওয়া দেখে বলরামের মনে পড়ে যায় সেদিনের কথা...
বিয়ের তিনমাস পূর্ণ হয়েছে এই কিছুদিন আগে। ঘোরতর বর্ষা চলছে। জেলেপাড়ায় আনন্দের বন্যা কেননা নদীতে প্রতিদিনই ধরা পড়ছে হরেক রকমের অনেক অনেক মাছ।
একদিন সারারাত মাছ ধরে মাছভর্তি নৌকা নিয়ে ভোরে বাড়ি ফিরে আসে বলরাম। মাছগুলোকে বিক্রয়ের উপযুক্ত করতে করতে দুপুর প্রায় বারোটা বেজে গেল দুজনের।
সব কাজ গুছিয়ে দুপুরের ভাত খেয়ে একটু শুয়ে বিশ্রাম নিচ্ছিল দুজন। এমন বরষার দিনে টিনের চালে অনবরত ঝমঝম শব্দে বৃষ্টি ঝরছে তো ঝরছে ঠিক যেন দুজনের জীবনের গল্পে মধুর কোনো আবহ সংগীত! ফুটো টিনের চাল থেকে দু-একটা বৃষ্টিচ্ছটা তাদের ভালোবাসাকে আরও মধুর থেকে মধুরতর একটা অনুভূতি দিয়ে যাচ্ছে কিছুক্ষণ পর পর! রাধারাণী একটু উষ্ণ হবে বলে মুখ গুঁজে বলরামের তপ্ত লোমশ বুকে।
বলরাম ও রাধারাণীর বক্ষ যুগলে যখন প্রেমের অন্তিম উষ্ণতা তখন নিতাইয়ের গলা হাঁকিয়ে ডাক, কী রে বলরাম ঘরে কী করিস্? শুনলাম নদীতে তো চিংড়ি মাছের বান বয়ে যাচ্ছে, আমি গেলাম, তুই জাল নিয়ে আয় তাড়াতাড়ি। বলরামও সাথে সাথে উত্তর দেয়,তুই যা, আমি অক্ষনই আইতাছি।
রাধারাণী খুবই বিরক্ত হয় নিতাইয়ের উপর। সে আরও আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলরামকে, বলে, আমাদের ঘরে তো অনেক মাছ, এমন মুহূর্তে আমাকে একা করে যেয়ো না।
বলরামও রাধারাণীর বক্ষে নিজেকে সপে দেয়, দুগালে-ঠোঁটে ইচ্ছেমতন চুমু দেয়, বলে, জেলের কী কখনও মাছের তৃষ্ণা মিটেরে বউ? মাছের অভাবে জেলেরা কখনো নদীতে যায়? যতই মাছ ঘরে থাকুক বা নদীতে মাছ নাই-বা থাকুক!
বলরামের কথা শুনে একটা বড় নিশ্বাস ফেলে রাধারাণী!
বলরাম বলতেই থাকে, বুঝলি বউ, মাছ ধরা জেলের কর্ম নয় শুধু, ধর্মও, আর মন্দির হচ্ছে ঐ নদী!
পুজো দিতে তো যেতেই হবে মন্দিরে।
রাধারাণী কোনোভাবেই ছাড়ে না, তার পা দিয়ে বলরামের দুই পা আঁটকে রাখে, হাত দিয়ে গলা জড়িয়ে থাকে শক্ত করে।
বলরাম নিরুপায়!
জীবনে এই প্রথম রাধারাণীর আহ্বানের কাছে হার মেনে নেয় নদীপুত্র বলরাম!
-- এসব ভাবতে ভাবতে চিত্ত চঞ্চল হয়ে ওঠে বলরামের।
গত বর্ষা মৌসুমে নদীতে যখন মাছের জয়জয়কার তখন বলরামের ট্রলারে ডাকাত পড়েছিল। বলরাম, হরিপদ, নিতাইসহ ট্রলারে আরও যারা ছিল তাদের বীরত্বে ডাকাতদল পালিয়ে গিয়েছিল ঠিকই কিন্তু ডাকাতের ছোড়া একটি গুলি বলরামের পায়ে এসে লাগে এবং তার ডান পা কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। চিকিৎসার খরচ যোগাতে গিয়ে তার বাবার রেখে যাওয়া দুটি মাছ ধরার নৌকা মহাজনের কাছে আজ বন্ধক!
-- এসব ভাবে সে সারাক্ষণ! ঘরে অভাব, আর কখন যে নদীর বুকে চিৎকার করে গান গাওয়া বলরাম খিটখিটে মেজাজের হয়ে গেছে বলরাম আর রাধারাণী কেউই বুঝতে পারল না!
খাটে শুয়ে শুয়ে বলরাম জিজ্ঞেস করে রাধারাণীকে, প্রদীপ কটায় স্কুল থেকে আসবে? এসে কী খাবে? খাওয়ার কিছু আছে ঘরে?
রাধারাণী কোনো উত্তর দেয় না।
উত্তর না পেয়ে বলরাম চিৎকার-চেঁচামেচি শুরু করে দেয়, বলে, এই মাগী তোর কানে কথা যায় না?
এবার রাধারাণী ভনভন করে উত্তর দেয়, আমার মাথা খাবে, তোর এত চিন্তা কীসের?
বলরাম এবার আরও ক্ষিপ্ত হয়ে যায়, অনেক কষ্টে খাট থেকে উঠে সোজা হয়ে দাঁড়ায়। বিছানার পাশে রাখা লাঠিটি হাতে নেয় এরপর একটা গেঞ্জি গায়ে দিয়ে লাঠিতে ভর করে চলে যায় নদী তীরে। শতবর্ষী বটগাছটির ছায়ার নিচে বসে সে।
হেমন্তের দুপুর! সূর্যকিরণে ত্বেজ তেমন একটা নেই বললেই চলে। ঝিরিঝিরি হাওয়ায় নদীর তীরে কাশফুলেদের দোলা। বলরামের দৃষ্টি গেল নদীর ওপারে, যেথায় কিছু কৃষক গান গেয়ে গেয়ে ধান কাটছে।
মন খারাপ করে সে তার ডান পায়ের দিকে তাকায়। মনে পড়ে, এমন দিনে সারারাত মাছ ধরেও বাড়তি কিছু আয়ের আশায় আমন ধান কাটাতে যোগ দিত সে।
কর্ম অক্ষম বলরাম তার চোখের জল থামাতে পারে না এসব দেখে!
কিছুক্ষণ পর তার চোখ যায় গ্রামের কিছু রমণী সারাদিনের কাজ সেড়ে স্নান করছে স্বচ্ছ নদীর জলে। তাদের ব্লাউজহীন ভেজা ফিনফিনে শাড়িতে সে অতীতের রাধারাণীকে দেখে!
এই তো আজ থেকে বছর আটেক আগে এই বটগাছেরই নিচে বসে নদীতে বড়শি ফেলে ডেব ডেব করে চেয়ে থাকত স্নানমগ্ন সদ্যযৌবনা রাধারাণীকে। রাধারাণীর এভাবে স্নান সেড়ে কলসি কাঁখে জল নিয়ে যাওয়া দেখে দেখে পরম উম্মাদনায় শরীরের মোহ থেকে ধীরে ধীরে তার মন মজেছিল রাধারাণীর প্রেমেতে!
প্রদীপ স্কুল থেকে এসে ভাত খেয়ে মাঠে চলে গেল তার বন্ধুদের সাথে খেলতে। রাধারাণীর মনটা খুব খারাপ। কিছুক্ষণ আগে বলরামের সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছে না। সারাক্ষণ শরীরের ঘাম ঝরিয়ে চলা বলরাম অদৃষ্টের কোন্ অভিশাপে আজ গৃহে শুয়ে-বসে দিন কাটাচ্ছে।
এসব ভেবে তার কোমল মন বলরামের জন্য হু হু করে ওঠে।
এসব ভাবতে ভাবতে নেমে আসে সন্ধে! প্রদীপও ঘরে ফিরে আসে। বলরাম কোথায় গেছে এখনো ঘরে ফেরার নাম নেই। প্রদীপকে সাথে নিয়ে বলরামের খোঁজে ঘর থেকে বের হয় রাধারাণী।
হেমন্তের এমন সন্ধে বেলায় শীতল হাওয়ারা এসে জুড়িয়ে দিয়ে যায় বলরামের শরীর,সাথে তার অস্থির মনকেও।
গ্রামের একমাত্র কালীবাড়ি থেকে শঙ্খধ্বনি ভেসে আসে। দুর্গাপূজা এখনও দেরি আছে তারপরও কারা যেন নিয়মিত ধূপ-ধুনো দিয়ে আরতি করে দুর্গাদেবীর অসমাপ্ত মণ্ডপে!
বলরামের দৃষ্টি নদী বক্ষে কিন্তু কান পাতে আরতিতে। এই কালীবাড়িতেই মা কালীকে সাক্ষি রেখে সে রাধারাণীর সিঁথিতে সিঁদুর পরিয়ে ঘরে তুলেছিল।
ঢাক-কাঁসার শব্দে তার মন রাধারাণীর জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠে। লাঠিতে ভর করে উঠে দাঁড়াবে বাড়ি ফিরবে বলে, এমন সময় শরীরের ভারসাম্য হারিয়ে গড়াগড়ি খেতে খেতে সোজা গিয়ে পড়ল নদীর জলে।
নদীতে এখন ভরা জোয়ার!
সূর্য ডুবে গেছে।
প্রদীপকে নিয়ে বলরামের খোঁজে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে চলে রাধারাণী। কোথায় যেতে পারে বলরাম!কোনো পুজোমন্ডপে তো সে কখনো যায় না এভাবে!
পথিমধ্যে বলরামের চেনা-জানা এক লোকের সাথে দেখা হয় রাধারাণীর, সে জানালো, বিকেলের দিকে ওকে নদীর তীরে বটগাছের নিচে বসে থাকতে না কি দেখেছে।
রাধারাণী ছুটে এল নদীর ধারে।
নিঃশব্দ নদীর কাদার ফাঁদে আটকে আছে বলরাম।
হঠাৎ রাধারাণীর কণ্ঠ কানে পৌঁছাতেই বলরাম মাথা তোলে তাকাল, চোখে বিস্ময়—
ঠিক সামনে রাধারাণী দাঁড়িয়ে,
দু’হাত প্রসারিত করে তাকে ডাকছে।
দু’জনের দৃষ্টি মিলল এক মুহূর্তে,
আর দেরি না করে রাধারাণী হাত বাড়াল।
বলরামও দু’হাত বাড়িয়ে দিল
ডুবে যাওয়া আত্মার শেষ ভরসার মতো।
রাধারাণীর হাতে প্রাণের শক্তি, সে শক্ত করে আঁকড়ে ধরে টেনে তুলল বলরামকে, ফিরিয়ে আনল নিঃশ্বাসে, জীবনে।
কাদা থেকে টেনে তুলেই ইচ্ছেমতো গালাগালি শুরু করে রাধারাণী। দুহাতের মুঠো দিয়ে চুল ধরে ঝাঁকি দিতে দিতে কাঁপা গলায় বলে—
মরার শখ হইছে? মরিস না কেন! আমাকে আর কত কষ্ট দিবি বল?
কথা শেষ হতেই তার গলা ভেঙে যায়। দম বন্ধ হয়ে আসা কান্নায়, বুক ফেটে যায় রাধারাণীর। অঝোর ধারায় ঝরে পড়ে চোখের জল।
কিছুক্ষণ পর অভিমান আর ক্রোধ ভেঙে দুজন দুজনকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। হুঁহুঁ করে কেঁদে বুক হালকা করে নেয় তারা।
সাক্ষী হয়ে থাকে নদীর জোয়ার। যেখানে একদিন রাধারাণীর প্রেমের ঢেউয়ে ভেসেছিল বলরাম।
আবছা আলোয় অসহায় বলরাম স্পষ্ট দেখতে পায় অদূরে তার সন্তান প্রদীপ মাটিতে বসে সবকিছু নীরবে প্রত্যক্ষ করছে।
রাধারাণী আর বলরামের সংসারে একমাত্র সন্তান প্রদীপ। তাদের সংসারে 'প্রদীপ' হয়ে এসেছে সাত বছর হয়ে গেছে। বলরামই নাম রেখেছিল প্রদীপ, একদিন সে অন্ধকারকে ঘুচে তার ঘর তথা তার সমাজে প্রদীপ জ্বালাবে বলে!
প্রদীপ এখন দল বেঁধে পাড়ার সব ছেলেমেয়েদের সাথে স্কুলে যায় বইখাতা নিয়ে। রাধারাণীই ভর্তি করে দিয়ে এসেছিল স্কুলে তাদের পাড়ারই এক শিক্ষিকার সাথে গিয়ে।
স্কুল থেকে ফিরে এসে মা ও বাবার মধ্যখানে শুয়ে স্কুলে কী কী হয়েছে এসব গল্প করে। বলে,জানো বাবা,আজ আমাদের মিস্ তার দুপুরের ভাত না খেয়ে শালিক আর কুকুরকে খাইয়েছে।
এই শোন না মা,মিস বলেছে, কুকুরটার নাকি বাচ্চা হবে। মা, বাচ্চা হলে আমি একটা নিয়ে আসব কেমন! আমাদের বিড়ালগুলোর সাথে মিলেমিশে থাকবে।
গল্প বলতে বলতে একপর্যায়ে হুট করে ঘুমিয়ে যায় প্রদীপ।
পৃথিবীর সব শিশুদের ঘুম মনে হয় এমনই!
রাধারাণী বলরাম গভীর আগ্রহে প্রদীপের গল্প শুনে আর মহানন্দে স্বর্গসুখে ভেসে যায়। প্রদীপ ঘুমিয়ে গেলে রাধারাণী পাগলের মতো চুমু দেয় ঘুমন্ত প্রদীপের কপোলে,কপালে, আর কী কী যেন বলে! পায়ে বিঁধা ছোট্ট কাঁটাটি বের করে আনে কাঁথা সেলাইয়ের ছোট সুঁই দিয়ে প্রদীপ যেন টের না পায়। হাফ্ পেন্টের পকেট থেকে মার্বেল, লাটিম বের করে তার বালিশের নিচে রেখে দেয়।
বলরাম বলে, ওর ঘুম ভেঙে যাবে তো! ওকে ঘুমাতে দে বউ, তুইও ঘুমা,সারাদিন এত পরিশ্রম করিস্!
একসময় সবায় ঘুমিয়ে যায়,পুরো জেলেপাড়াও গভীর ঘুমে মগ্ন, কিন্তু বলরাম ঘুমাতে পারে না।
আজ মহাষষ্ঠী।
সন্ধে হতে না হতেই পুরো জেলেপাড়ায় নেমে আসে আনন্দের বন্যা। দলে দলে ছোটো ছোটো ছেলেমেয়েরা নতুন পোষাক পরে মন্দিরে যায়, বিভিন্ন রকম বাজি পোড়ায়।
পা পিছলে পড়ে শরীরের বিভিন্ন জায়গায় আঘাত পেয়ে বলরামের গায়ে জ্বর।
বলরামকে বলে রাধারাণী সন্তানকে নিয়ে মন্ডপে যায় পুজো-আরতি দেখতে।
এদিকে রাধারাণী প্রদীপকে নিয়ে ঘরের বাহির হতেই বলরাম খুঁজতে থাকে ফুটো টিনের চাল ঠিক করতে চাওয়া রাধারাণীর সেই টাকাগুলো।
অনেক খোঁজাখুঁজির পর টাকাগুলো পেয়ে যায় বলরাম, সাথে পায় একটি হিসেবের কাগজও।
পড়ে দেখে,প্রদীপের বই-খাতা কেনা, তার ওষুধ কেনা টাকার পাইপাই করে হিসাব!
কাগজটি পড়ে পড়ে বলরাম কাঁদতে থাকে!
বিয়ের পরের দিনগুলো থেকে আজ অবধি যতগুলো টাকা সে রাধারাণীকে দিয়েছে একটি টাকাও এদিক-সেদিক বিনা প্রয়োজনে খরচ করেনি।
বলরামের গুমোট কান্না একসময় গগনবিদারী হয়ে মাইকে ভেসে আসা আরতির ঢাক-কাঁসার শব্দে মিশে যায়।
মা ছেলে পুজো দেখে ঘরে ফিরে আসে।
মায়ের সাথে পুজো দেখে এসে প্রদীপের মনটা খুব খারাপ। বলরাম জিজ্ঞেস করে, মন খারাপ কেন বাবা? মা কিছু কিনে দেয়নি?
প্রদীপ কোনো উত্তর দেয় না।
রাধারাণীকে জিজ্ঞেস করলে বলে,
তোমার ছেলে কী বলে শুনো!
প্রদীপকে কাছে টেনে অনেক আদর করে বলে,কাল তোমাকে আমি নিয়ে যাব, কাল আরও অনেক বেশি আনন্দ হবে।
প্রদীপ মাথা নাড়ে,বলে,বাবা আমি আর কখনও দুর্গা দেখতে যাব না!
রাধারাণী রাগ করে বলে, প্রতিমা দেখে দেখে তোমার ছেলে অসুরের জন্য কাঁদছে। এতগুলো মানুষের সামনে আমাকে জিজ্ঞেস করছে, এই লোকটাকে এভাবে মারছে কেন সবাই মিলে? দেখো না মা, সিংহও কামড়াচ্ছে কেমন করে!কোথায় তাকে হিংস্রপশুর আক্রমণ থেকে রক্ষা করবে; তা না করে উল্টো মারছে। আবার একটা নিরীহ প্রাণী মহিষকেও কেটে ফেলেছে।
তুই বুঝিয়ে বলতে পারিসনি ,বলরাম বলে।
বলেছি তো,এই অসুর ব্যাটা হচ্ছে শয়তান,জগতে এমন কোনো কুকর্ম নেই সে করে না, স্বর্গ মর্তের সব সুখ বিনাশকারী সে! তাই মা দুর্গা তাকে এমনভাবে বধ করছে। ওর প্রাপ্য শাস্তি ওকে বুঝিয়ে দিচ্ছে।
তা-ও তোমার ছেলেকে সন্তুষ্টি করতে পারিনি।
উল্টো জিজ্ঞেস করে,দুর্গা মা যদি এত শক্তিধর হয় তাহলে দশ হাতে এত অস্ত্র লাগবে কেন? মায়ের আদর, স্নেহ ও মমতায় তাকে বশে আনতে পারল না? আমি তো তোমার সব কথা শুনি মা!
শাড়ি পাল্টাতে পাল্টাতে রাধারাণী বলে,তোমার ছেলে আরও বলে কী জানো, মা দুর্গার চেয়ে ওর স্কুলের মিস্ নাকি অনেক ভালো! কুকুর-পাখিকে আদর করে,কক্ষনো মারে না! খেতেও দেয়।
শিশুমনের এমন সরল প্রশ্নে বলরাম হতভম্ব হয়ে যায়। ছেলেকে কীভাবে বোঝাবে ভাবতে থাকে।
বলরাম পরম আদরে কোলে তুলে নেয় প্রদীপকে,বলে,বাবা আজ তুমি যেই দুর্গাকে দেখেছ দশ হাতে দশ অস্ত্রে,সেটা আসলে তোমার মা।
প্রদীপ হাসে বাবার এমন কথা শুনে।
বলরাম বলেই যায়, দশভূজা মানে কি জানো বাবা, এই যেমন ধরো আমি আজ অনেকদিন পঙ্গু হয়ে শয্যাশায়ী, তাই বলে তুমি আমি কি একবেলাও অভুক্ত থেকেছি? তুমি একদিনও স্কুল মিস্ করেছ? আমি কি একদিনও আমার ওষুধ না খেয়ে থেকেছি? আমাদের ঘরের হাঁস-মুরগিগুলো কি না খেয়ে থেকেছে? বলো বাবা বলো?
প্রদীপ উত্তর দেয়, না বাবা!
বলরাম আবার জিজ্ঞেস করে, তাহলে কীভাবে হয় এতকিছু?
প্রদীপ বলে, মা করে তো সব!
সেটাই বলছি বাবা, সেটাই নারীর শক্তি! সারাদিন কাজের পর খেয়ে তুমি আমি যখন বিশ্রাম করি দুপুরে তোমার মা তখন সেলাই করে, ওগুলো বিক্রি করে। এককথায় যদি বলি সংসারের দশদিক তোমার মা একাই সামাল দেয়,যা আমার পক্ষে এখন আর সম্ভব নয় বাবা!
এবার বুঝেছ দশহাতে ওগুলো যে দশঅস্ত্র নয়; দশদিক সমাধান! আর যে অসুরের জন্য তুমি কান্নাকাটি করেছ সেটি কিন্তু তুমি, আর যে দুর্গাকে দেখেছ সেটিও!
বাবার কথাগুলো তন্ময় হয়ে শুনে প্রদীপ,বলে,তারপর...
তোমার অন্তরে পুষে রাখা হিংস্রতা-গ্লানি-দ্বেষ,পরের ক্ষতি করে নিজের সার্থসিদ্ধি এসবই তো অসুর, যা তুমি আমি লালন করছি সযতনে, তোমার-আমার অন্তরে।
এই ধরো, মা দুর্গার সব শক্তি তুমি অন্তরে ধারণ করলে, হলে দুর্গতিনাশিনী, তারপর তুমি ঝাপিয়ে পড়লে তোমারই অন্তরের ভিতর বসত করা অসুরকে বধ করতে।
এবার ফলাফল কিন্তু তোমার হাতে, কে বিজয়ী হবে, তুমি নাকি অসুর!
বাবার কথাগুলো গিলতে থাকে প্রদীপ, মৃদু কণ্ঠে বলে,আরেকটু সহজ করে বুঝিয়ে বলো বাবা
এই যেমন ধরো, আমি একজন জেলে নদীতে মাছ ধরে আমার জীবন চলে, মনের আনন্দে মাছ ধরি, সেই নদীর জলে কেউ যখন বিষ মেশায় , যারা সিন্ডিকেট করে জিনিসপত্রের দাম বাড়ায়,দেশের হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার করে আরাম-আয়েশে জীবন কাটায়। সদ্যজাত শিশুদের দুধ ও ওষুধে ভেজাল মেশায়! পারমাণবিক বোমার ব্যবহার করে এই শীতল সবুজ মর্তকে করছে প্রতিনিয়ত বিষাক্ত তাদের অন্তরে যদি বছর বছর এমন পুজোর দিনে এই বার্তাটি পৌঁছাত তাহলে কী পৃথিবীতে এত অনাচার-অবিচার থাকত বাবা, তুমি এবার একটু চিন্তা করে বলো।
তুমি মাটির মূর্তির যে রূপ আজ দেখে মাকে এতকিছু জিজ্ঞেস করলে সেটি তো আসলেই একটি অনুষ্ঠান বাবা, তোমাকে দুর্গা মায়ের বার্তাটিকে অন্তরে ধারণ করতে হবে যে!তাহলেই মায়ের পূজা সার্থকতা পাবে,না হলে কখনও নয়।
প্রদীপের অন্তরে স্নিগ্ধ একটা দোলা দিয়ে যায়। মা দুর্গাকে মনের অজান্তেই অন্তরে গেঁথে ফেলে।
বাবার কথাগুলো শুনতে শুনতে বাবার কোলেই ঘুমিয়ে পড়ে এইমাত্র পুজো দেখে আসা ক্লান্ত প্রদীপ।
ছেলেকে খাটে শুয়ে দিয়ে রাধারাণীকে ডাকে বলরাম, বলে, কাল একটু হরিপদ ও নিতাইকে আমাকে দেখে যেতে বলিস তো বউ, সদরে মাছের আড়ৎদারের কাছে আমার বেশ কিছু টাকা পাওনা আছে, দিবে দিবে করে আজ অনেকদিন হয়ে গেছে, দেখি এদের পাঠিয়ে কিছু পাই কি না!
কাক ডাকা ভোরে ঘুম থেকে ওঠে যায় রাধারাণী। স্নান সেড়ে পুরো ঘর স্বর্ণরোপ্যের জল ছিটিয়ে পবিত্র করে গৃহদেবতার পূজা দেয়। কিছুক্ষণ সুর করে চণ্ডীপাঠ করে! পঞ্জিকা পড়ে জানতে পারে এবার মা মর্তে এসেছেন হাতির পিঠে চড়ে। শাস্ত্রমতে যা মঙ্গলের বার্তা! তবুও গতরাতের অবুঝ সন্তানের কী সব অমঙ্গলে কথাবার্তা, এদিকে বলরামেরও জ্বর, নদী তীরের কাদায় দেবে অল্পের জন্য মৃত্যু থেকে রক্ষা, এসব রাধারাণীর মনকে অজানা এক আতংকে ফেলে দেয়।
চিৎকার করে দুগ্গা-দুগ্গা ধ্বনি তোলে রাধারাণী।
এরপর বলরাম ও প্রদীপকে গরম গরম ভাত খাইয়ে নিতাই ও হরিপদের সাথে দেখা করতে ঘর থেকে বের হয় রাধারাণী।
অল্প কতদূর গিয়েই দেখা হয়ে যায় গ্রামের সেই মহাজনের সাথে যার কাছে বলরাম অপারেশনের জন্য টাকা নিয়েছিল তার নৌকা দুটি বন্ধকি রেখে।
মাথায় ঘোমটা টেনে পা ছুঁয়ে প্রণাম করে মহাজনকে। মহাজন উচ্চকণ্ঠে বলে, দীর্ঘজীবী হও মা জননী। বলরাম এখন কেমন আছে? তারপর নিচুস্বরে বলে, মা-জননী টাকা নিয়েছো তো বছর পার হয়ে গেছে, মাসে মাসে সুদ তো দিচ্ছই না তার উপর আসলের তো কোন খবরও নেই। তো মা-জননী, বলরামকে আমার সাথে একবার দেখা করতে বলিও কষ্ট করে হলেও,বলিও,আর কিছুদিন হলে নৌকা দুটি কিন্তু আমার হয়ে যাবে।
এখন যাই মা জননী। সকালের এই পবিত্র লগ্নে মা দুুর্গার পায়ে একটু অঞ্জলী-পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করে আসি। দুগ্গা-দুগ্গা-দুগ্গা! জয় মা দুর্গতিনাশিনী এই ধ্বনি দিতে দিতে মণ্ডপের দিকে চলে যায় মহাজন।
একবুক হতাশা ও চোখের জলকে ভর করে রাধারাণী ছুটে হরিপদ আর নিতাইয়ের বাড়িতে।
####
নিতাই, হরিপদ নবমীর দিন এসে দেখা করে বলরামের সাথে। কয়েকজন আড়ৎদারের কাছে বলরামের লেনদেন আছে সেই ব্যাপারে আগে থেকে কিছুটা জানত! বলরামকে স্বান্তনা দেয়, বলে,কালই আমরা দু'জন আমাদের কাজে এমনিতেও সদরে যাব,দেখি সওদাগরকে তোর অবস্থার কথা বলে কিছু করা যায় কি না!
রাধারাণী মুড়ি-নাড়ু আর জল খেতে দেয় দুজনকেই! নৌকা বন্ধক রাখা মহাজনের বলা কথাগুলো একবারের জন্যেও মুখে আনেনি রাধারাণী!
দশমীর দিনেও সদরঘাটে ভোর থেকে মাছের জমজমাট কাজকারবার,কারও শ্বাস ফেলার যেন সময়টুকুও নেই! বলরাম যাদের কাছে টাকা পায় সবারই দুয়ারে দুয়ারে ঘুরে নিতাই আর হরিপদ।
সবার মুখে একই সুর,বলে,ব্যবসার অবস্থা খুবই মন্দা,মাছ কেনার টাকা নেই, ব্যবসা টিকিয়ে রাখতেই হিমসিম খাচ্ছে। আরও ক'দিন অপেক্ষা করতে বলে বলরামকে।
বলরামের এমন অবস্থা জেনে, যেহেতু বলরাম এখন আর, নিয়মিত মাছ দিতে পারবে না, এরা আরও সুযোগ পেয়ে যায়! যতদিন টাকা না দিয়ে পারে ততদিন যেন বাঁচে!
নিরাশ হয় নিতাই, হরিপদ। ভাবে, অসুস্থ অসহায় বলরামকে কী বলবে!
এ আড়ৎ ও আড়ৎ করতে করতে বেলা দুটো বেজে যায়। নৌকা আর জাল মেরামতের আনুষঙ্গিক মালপত্র কেনা শেষ তাদের।
একটা ভাতের দোকানে বসে দুপুরের খাওয়া সেড়ে নেয় দুজনেই।
মাছের আড়ৎ এর একদম শেষ দিকে মেসার্স গৌরাঙ্গ অ্যাণ্ড ব্রাদার্স। বাপ দাদা সহ চার পুরুষের মাছের আড়ৎদারির ব্যবসা এদের।
সেই আড়ৎ'এ প্রবেশ করে নিতাই আর হরিপদ। আড়ৎ এর ভিতরের শয়ন কক্ষে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন মালিক নিখিল চন্দ্র রায়। বাবা রামমোহন রায় এর মৃত্যুর পর মেসার্স গৌরাঙ্গ অ্যাণ্ড ব্রাদার্সের দায়িত্ব নেয় নিখিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ চুকে গভীর মনোনিবেশ করে তিন পুরুষের এই ব্যবসায়। বেশ উন্নতিও করেছে।
নিখিল স্বভাবে রাশভারি।
দোকানের এক কর্মচারীর মাধ্যমে জানতে পারে হরিপদ ও নিতাই দেখা করতে চায়। দুজনকেই শয়নকক্ষে ডাকে এবং কী কী মাছ আছে জানতে চায়।
হরিপদ বলে, মাছ নয়,বলরামের খবর জানাতে এসেছি মালিক।
এরপর বলরামের বর্তমান অবস্থার সব কথা খুলে বলে নিখিলকে। নিখিল বালাম খাতা চেক করে দেখতে পায় তিন দাগে বেশ কিছু টাকা পাওনা আছে বলরামের।
নিখিল খাতা বন্ধ করে নিতাই ও হরিপদকে বলে আপনারা আমাকে বলরামের বাড়ির ঠিকানাটা দিয়ে যান এই বলে দুজনকে বিদায় দেন।
মা দুর্গাকে বিদায় দেওয়ার প্রস্তুতি নিতে নিতে কখন যে দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেছে রাধারাণী এতটুকুও টের পায়নি। মাথার মধ্যে শুধু একটাই চিন্তা কখন সদর থেকে হরিপদ ও নিতাই ফিরে আসবে কোন সুসংবাদ নিয়ে অথবা আড়ৎদারগন যদি কোন টাকা না দেয়!
এসব চিন্তায় চিন্তায় রাধারাণী অস্থির! মা দুর্গার বিদায়ক্ষনে সারাদিন বিছানায় শুয়ে থাকা বলরামকে দেখে রাধারাণীর মনের গভীরে কান্নার ঝড় বয়ে যাচ্ছে অথচ এতটুকু প্রকাশ যার হয়নি।
প্রদীপকে সাথে নিয়ে একটি কাঁসার তালায় পুজোর কিছু সামগ্রী সাথে তেল-সিঁদুর নিয়ে মা দুর্গাকে বিদায় দেয় চোখের জলে ভেসে।
মাকে বিসর্জন দিয়ে ঘরে ফিরে আসে রাধারাণী।
প্রবল বেগে ধেয়ে আসা জোয়ারের জল আর কতই বা বাঁধকে গ্রাহ্য করে!
অঝোর নয়নে কাঁদতে থাকে রাধারাণী।
রাধারাণীকে এমন করে কাঁদতে দেখে বলরাম পাশে এসে বসে, বলে,বউ তুই এভাবে কাঁদলে আমি কোথায় যাব বল্, আর প্রদীপও যে মন খারাপ করে আছে দেখ্! কারও দিন কখনও থেমে থাকে না বউ,এমন বিপদের দিনে অন্তরে শক্তি ধারণ করতে হয়,উঠ আমাদের হালকা কিছু থাকলে খেতে দে।
দশমীর পরদিন হঠাৎ জেলেপাড়ায় একটা সাদা ধবধবে কার প্রবেশ করল। ড্রাইভারের পাশে থেকে বিশাল গোঁফওয়ালা একজন মাঝবয়েসী লোক আর পিছনে সাদা পাঞ্জাবি পরা একজন যুবক গাড়ি থেকে নামল। গাড়ি দেখে পাড়ার ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা গাড়ির কাছে গিয়ে ভিড় জমালো। গোঁফওয়ালা লোকটি বাচ্চাদের জিজ্ঞেস করে, বলরামের বাড়ি কোনটা বলতে পার খোকা? সাথে সাথে প্রদীপ উত্তর দেয়, তিনি আমার বাবা। প্রদীপ ওনাদের নিয়ে আসে তার বাড়িতে। রাধারাণী তখন উঠোন ঝাড়ু দিচ্ছিল, কাউকে চিনতে না পেরে একদৌড়ে হাফাতে হাফাতে বলরামের কাছে এসে বলে,এইই একটু কষ্ট করে উঠো, দেখো তো আমাদের ঘরে কে এসেছে!
বলরাম হতভম্ব হয়ে যায় নিখিলকে দেখে। ঘরে এনে বসতে দেয় তার খাটে। রাধারাণীর সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়।
একসময়ের তীরের মত সূঁচালো দেহের বলরামকে একটি পা কাটা দেখে মনের গভীরে বড় একটি নিশ্বাস ফেলে নিখিল।
নিখিলের হিসাব রক্ষক নিমকি-মিষ্টির প্যাকেটটি রাধারাণীর হাতে তুলে দেয়।
এরপর বলরাম ধীরে ধীরে তার জীবনে ঘটে যাওয়া পুরো কাহিনি সবিস্তারে বলে নিখিলকে।
নিখিল শুনে যায়।
বলরামের সব কথা শেষ হলে জানতে চায়, তুমি এখন কী করতে চাও বলরাম আর তোমার নৌকাগুলোই বা কী করবে? তখন মহাজনের সাথে দেখা হওয়ার সময় রাধারাণীকে মহাজনের বলা কথাগুলো বলে ফেলে রাধারাণী নিখিলের কাছে।
তখন নিখিল বলরামকে বলে,তুমি তো তাহলে নৌকা দুটিও হারালে বলরাম!
বলরাম নৌকা দুটোর হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার খবরে মাথা নিচু করে কাঁদতে থাকে তার বাবাকে স্মরণ করে করে। বলে,এই নৌকা দুটি আপনার পিতামশাই আমার বাবাকে দিয়েছিলেন, মাছ ধরে দোকানে দিয়ে নৌকার দাম পরিশোধের শর্ত সাপেক্ষে। যাহা বাবা ধীরে ধীরে মাছ লেনদেনের মাধ্যমে পরিশোধ করে। এরপর নিখিল বলরামের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে, আমি জানি বলরাম যদিও বাবা কখনও আমাকে বলেননি। তোমার লেনদেনের হিসাব খুঁজতে গিয়ে এই হিসাবরক্ষক কাকা গতকাল আমাকে দেখায়।
তুমি পুরুষ,এভাবে কাঁদছ যা তোমাকে মানায় না।
এরপর হিসাব রক্ষককে চেক বইটি হাতে দিতে বলে আর বলরামকে বলে, বলরাম একসপ্তাহের মধ্যে তোমার বাড়ির জং ধরা টিন আর সামনের উঠোনের সব মেরামতের কাজ শেষ করবে। স্কুলে আমি বলে যাচ্ছি প্রদীপের সকল খরচ যেন আমার থেকে সংগ্রহ করে।
তোমার ছেলে প্রদীপ যতটুকু পড়াশোনা করতে চায় সব খরচ আজ থেকে আমার।
এই বলে স্বাক্ষর করে একটা চেক নিখিলের হাতে দেয়।
টাকার পরিমান দেখে হাউমাউ করে কেঁদে দেয় বলরাম।এরপর নিখিলের পায়ে পড়ে বলে আমি এত টাকা আপনার কাছে পাই না মালিক,আমাকে আশীর্বাদ করুন, দয়া নয় করুনা নয় মালিক ৷
এরপর কাঁদতেই থাকে বলরাম।
পা থেকে তুলে বলরামকে বুকে টেনে নেয় নিখিল,বলে, বাবার কাছে শুনেছি গৌরাঙ্গ অ্যন্ড ব্রাদার্স আজকের এই অবস্থায় আসতে তোমার বাবার অনেক অবদান ছিল। আজ আমি তোমাকে দান দিতে আসিনি, ঋণ শোধ করতেও আসিনি, এসেছি তোমার প্রাপ্য দিতে।
এই বলে রাধারাণীর দেয়া জলপান মুখে দিয়ে সদরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলো নিখিল।
নিখিল চলে যাওয়ার পর রাধারাণীকে অনেকক্ষণ ধরে বুকে জড়িয়ে রাখে বলরাম।
স্রোতহীন,জোয়ার ভাটাহীন পচাগলা নদীর জলেতে যখন হঠাৎ সাগরের জোয়ারের জলে টইটম্বুর হয়ে কলকল শব্দ করে, ঠিক তেমন একটা শব্দ শুনতে পায় রাধারাণী বলরামের বুকের গভীরে।
বলরামের বুকের মাঝে সেই সুর নিথর হয়ে শুনতে থাকে রাধারাণী।
বলরাম বলে, দেখলি তো বউ তোর ছেলের নাম কেন আমি প্রদীপ রেখেছিলাম এবার বুঝলি তো?
তুই সাক্ষাত আমার ঘরের লক্ষ্মী, তোর কষ্ট একটুকুও বিফলে যায়নি। মা দুর্গা তোর চোখের জলের মর্ম বুঝেছে।
এই টাকা দিয়ে আমাদের বাজারে আমি একটা দোকান দেব ; কী বলিস বউ? তুই আর আমি মিলে সেই দোকান পরিচালনা করব, কী পারবি না?
একদিন বিদ্যা বুদ্ধিতে জ্ঞান গরিমায় আমাদের প্রদীপ অনেক বড় হয়ে পুরো জেলেপাড়া আলোকিত করবে। কী? ঠিক বলেছি না?
কথাগুলো শুনতে শুনতে রাধারাণী আবারও হারিয়ে যায় সুঠাম লোমশ বুকের বলরামের বক্ষ মাঝে।
দুজনের বুকের মধ্যখানে কখন যে প্রদীপ এসে স্থান করে নেয় কেউ এতটুকু বুঝতেই পারল না।
আজ আগামী/সাহিত্য
0 মন্তব্যসমূহ