প্রিয়জন

 


বই : প্রিয়জন ।
লেখক : তাসনুভা সোমা ।
ধরন : উপন্যাস ।
মূল্য : ৩০০ টাকা (কুরিয়ার চার্জ ফ্রি)

একটুখানি পড়ে দেখুন

\ ১ \

মাধবির ক্যান্সার ধরা পড়ার পর থেকে খান পরিবারের ছন্দপতন শুরু। ক্যান্সারটা ঝড় তুলে দিয়ে যায় ছোট্ট সুখের পরিবারটিতে। মাধবির স্বামী জাহিদ স্ত্রীর এই অসুখের সাথে তাল মেলাতে ব্যর্থ হয়। দিনের পর দিন ব্যস্ত থেকে ব্যস্ততর হতে থাকে ব্যবসায়। মাধবি-জাহিদ দম্পতির একমাত্র মেয়ে নিলা তখন দশ বছর বয়সী। মায়ের অসুখ ধরা পড়ার পর থেকে ওর জীবনটাও আর স্বাভাবিক নেই। নিলা দেখছে মা অসুস্থ। কখনও বাসায়, কখনও হাসপাতালে থাকছে মা। বাবা তার ব্যবসার কাজে কখনও বাসার বাইরে, কখনও দেশের বাইরে। মাধবির দীর্ঘ অসুস্থতার সময়ে বাবার বাড়ির আত্মীয়-পরিজন শারীরিক, মানসিক, আর্থিক কোনদিক থেকেই সাপোর্ট দিতে পারেনি ওকে। তেমন কেউ ছিলও না। বাবা-মা আগেই মারা গেছে। ভাই-বোনরা প্রথম প্রথম দেখতে আসত। কিছুদিন পর সেটাও বন্ধ হয়ে যায়। মাধবি কষ্ট পায়নি। সেটা বরং এক ধরনের মুক্তির অনুভব দিয়েছিল। ওরা অসুস্থ বোনকে দেখতে এসে প্রতিবার একই ধরনের কিছু কথা বলত,

- মাধবি কেমন করে এরকম একটা অসুখ বাধালি? 

- তোদের এত টাকা-পয়সা, এত বিলাসিতা! সেসব দিয়েও আটকানো গেল না এরকম অসুখ-বিসুখ! তাই বা কেন বলি! এসব তো ধনীদেরই অসুখ। গরীবদের এসব হয় না। 

- তোর মেয়েটার জন্য খুব খারাপ লাগেরে। ভাগ্যটাই খারাপ মেয়েটার। এত ছোট বয়সে মাকে ছাড়া থাকছে। 

- তোর জামাইয়ের এত টাকা! তোর কোনো চিন্তা নেই। যেখানে যে খরচ করতে হয় করবে। তুই এদিক দিয়ে নিশ্চিন্তে থাক

- এতদিন তোকে দেখতে আসলাম কিন্তু তোর জামাইকে একবারও দেখলাম না। কোথায় থাকে লোকটা! সারাক্ষণ শুধু ব্যবসা আর কাজ। বউয়ের কাছে একটু থাকলেও তো পারে! শুধু টাকা ঢাললেই কি আর হয়! একটু মনোযোগ, একটু সময়ও তো দেয়া উচিত!

- হ্যারে তোর শ্বশুরবাড়ি থেকে কেউ আসে না তোকে দেখতে? 

- তোর খাওয়া-দাওয়ার কী অবস্থা? সবকিছু খেতে পারিস! বাসা থেকে খাবার পাঠায়, না কি হাসপাতালের খাবার খাচ্ছিস? 

এই কথাগুলোর মধ্যে একটা কথাও মাধবির জন্য কোনো কাজের কথা না। মাধবি চাইত ওর ভাই-বোনেরা আন্তরিক স্নেহ, মায়া, মমতার টানে ওর কাছে আসবে। ওর সাথে সময় কাটাবে। কখনো-সখনো নিলার সাথে সময় কাটাবে। নিলাকে নিজেদের বাসায় নিয়ে যাবে। বাসা থেকে নিজের হাতে তৈরি করা কিছু খাবার নিয়ে আসবে। হাসপাতালের খাবার খেতে খেতে মাধবি যখন ক্লান্ত তখন ওর এসব শুনতে ভালো লাগত না। তোর খাওয়া-দাওয়ার কোনো অসুবিধা হচ্ছে নাতো? মাধবিকে যখন ওরা জিজ্ঞেস করত, মাধবি কেমন করে এরকম একটা অসুখ বাধালি? তখন এর উত্তরে মাধবি কী বলবে! ক্যান্সার কি নিজের হাতে বাঁধানোর অসুখ! ওর স্বামীর টাকা-পয়সা আছে সেটা সত্যি কিন্তু রক্ত সম্পর্কের ভাইবোনের ভালোবাসার কাছে সেসবের মূল্য কতটুকু! ভাইবোনের ভালোবাসা চাইত মাধবি। আর জাহিদকে নিয়ে সুযোগ পেলেই এটাসেটা খোঁচামারা নেতিবাচক কথাবার্তা একেবারেই ভালো লাগত না ওর। জাহিদই একমাত্র মানুষ যে কিনা কোনো বাক্যব্যয় না করে মাধবির সুস্থ হওয়ার অপেক্ষায় আছে। সে মাধবির পাশে থাকতে পারে না, স্ত্রীকে সময় দিতে পারে না। কিন্তু তবুও মাধবি জানে শুধু সে-ই জাহিদের প্রিয়জন। ঠিক যেমনটি মাধবির প্রিয়জন জাহিদ। ওর এই কঠিন অসুখ জাহিদকে কতটা কষ্টে, কতটা দুশ্চিন্তায় রেখেছে মাধবি সেটা বোঝে। কাজেই স্বামীর সম্পর্কে কোনো নেতিবাচক কথা শুনতে ভালো লাগে না ওর। 

এসবের বাইরেও বোনের অসুস্থতার সময়ে মাধবির ভাইবোনের মধ্যে পৈতৃক সম্পত্তি নিয়ে নির্লজ্জ লড়াই শুরু হয়ে যায়। তারা সবাই আলাদাভাবে নিজেদের নিচু মানসিকতার পরিচয় দিতে শুরু করে। ভাইদের দাবি ছিল মাধবি যেন বলে দেয় সে পৈতৃক সম্পত্তির ভাগ চায় না। বোনেরা এই একই বিষয় নিয়ে মাধবিকে বলে সে যেন কখনই পৈতৃক সম্পত্তির দাবি না ছাড়ে। সেটা ঠিক হবে না।

ভাইদের বক্তব্য: বোন তুই আমাদের সব ভাইবোনের সামনে বলে দে তুই সম্পত্তির দাবি ছেড়ে দিচ্ছিস। দেখ তোর মাত্র একটা মেয়ে। তোর জামাইয়ের এত বড়ো ব্যবসা। তোর অনুপস্থিতিতেও নিলার কোনো অসুবিধা হবে না। আমাদের কথা একটু চিন্তা করে দেখ। আমরা সেই চিরদিনের মধ্যবিত্তই থেকে গেলাম। তোর অংশের সম্পত্তিটা পেলে আমাদের ছেলেমেয়ের ভবিষ্যৎ কিছুটা ভালো হতো। তুই ধনী লোকের স্ত্রী। আমাদের পৈতৃক সম্পত্তির এইটুকু অংশ পাওয়া না-পাওয়ায় তোর কিছুই যাবে-আসবে না। তোর জন্য খুবই সামান্য সম্পত্তি কিন্তু আমাদের জন্য সেটা অনেক। আরেকটা কথা মনে রাখিস, আমরা তোর এই অসুখের মধ্যে সম্পত্তি নিয়ে কোনো কথাই বলতাম না। আমাদেরকে এতটা খারাপ মনে করিস না বোন। কিন্তু বোনদের চাপে বলতেই হচ্ছে। ওরা সম্পত্তি ভাগাভাগি নিয়ে খুব চাপ দিচ্ছে। আমাদের এত তাড়া নেই। আমরা তো সেই পুরোনো বাড়িতে মিলেমিশে ভালোই আছি। কিন্তু আমাদের বোনদের এখনই সেই পুরোনো বাড়ি ভেঙে ফ্ল্যাট বিল্ডিং বানাতে হবে। যেন ওরা ওদের নামে একটা করে ফ্ল্যাট নিয়ে নিতে পারে। 

বোনদের কথা শুনলে মাধবির মনে হতো তারাও নির্লজ্জ এই প্রতিযোগিতায় ভাইদের চেয়ে মোটেই পিছিয়ে নেই। তাদের বক্তব্য: মাধবি তুই আমাদের অনেক আদরের বোন। আমরা কোনোমতেই তোকে বাবার সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করতে চাই না। আমাদের ভাইদের একটা ষড়যন্ত্র এটা। তুই নিশ্চয় ভাবছিস আমরা কেন এরকম ভাবছি! তুই হয়তো এটাও ভাবছিস ওরা শুধু তোকে ঠকাতে চাইছে। ভুল ভাবছিস। ওরা তোকে ব্যবহার করে আমাদের দুজনকেও ঠকাতে চাচ্ছে। তুই যখনই ওদেরকে বলবি তুই পৈতৃক সম্পত্তি নিবি না, তখন ওরা আমাদের দুজনকেও চাপ দিবে। তোর তুলনা দিয়ে বলবে আমরাও যেন সম্পত্তির দাবি ছেড়ে দিই। তুই ভুলেও দাবি ছাড়বি না। ঠিক আছে মানছি তোর এসবের দরকার নেই কিন্তু তবুও ছাড়বি না। দরকার হলে তুই বরং এখনই নিয়ে নে। তোর অসুখের সময়েই। তারপর আমাদের দুজনকে দিয়ে দিস। আরেকটা কথা বলা উচিত। তোর অসুখের মধ্যে আমরা এসব নিয়ে কথা বলতাম না। কিন্তু ভাইদের চাপে না বলে থাকতে পারছি না। বোন হিসেবে আমাদের কথাটা ভেবে দেখিস। 

পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে মাধবি সবচেয়ে ছোটো। বাকি চারজনের মধ্যে দুই ভাই আর দুই বোন। ওদের আচরণে মাধবি কষ্ট পেয়েছে সন্দেহ নেই। মায়াও লাগত ওদের জন্য। ওদের তুলনায় মাধবির আর্থিক অবস্থা ভালো। নানান সময়ে উৎসবে-অনুষ্ঠানে মাধবি ওদেরকে আর্থিক সহায়তা দিয়েছে। কখনও উপহার হিসেবে, কখনও ঋণ হিসেবে। বিষয়টা এরকম হয়ে যাবে সেটা মাধবির ধারণার বাইরে ছিল। রক্তসম্পর্কের ভাইবোনেরা মাধবিকে এখন শুধু আর্থিক লাভ-লোকসানের উৎস হিসাবে গণ্য করে। ওরা ভুলে গেছে মানবিকতা, ওদের ছোটবোনের ভালোবাসার কথা। ছোটবোনের প্রতি, বোনের মেয়ের প্রতি কোনো প্রকার দায়িত্বের কথা। ওদের জন্য একপর্যায়ে করুণা বোধ করতে শুরু করেছে মাধবি। 

আরেকদিকে ওর শ্বশুরবাড়ির আত্মীয়রা চিন্তা করত তাদের ছেলেকে নিয়ে। মাধবি এবং ওর মেয়ে নিলাকে নিয়ে চিন্তা ছিল না তাদের। মাধবি কেমন আছে, কতটুকু সুস্থ হয়ে উঠছে, নিলা কীভাবে বড়ো হচ্ছে—সেসব নিয়ে ভাববার কোনো অবসর ছিল না ওদের। মাধবির শ্বশুরবাড়ির আত্মীয়রা বলত,

- ইস জাহিদের যত্ন নেওয়ার কেউ নেই! কী খাচ্ছে, কী করছে একা একা! সকাল-বিকাল হাতের কাছে এটা-ওটা এগিয়ে দেওয়ারও কেউ নেই। কাজের লোক দিয়ে কী আর জীবন চলে!

- সেটাই তো! ভাইটা কত কষ্টে আছে! কাজের লোকজন দিয়ে জীবন চললে কেউ আর বিয়ে করত না। জীবন এভাবে চলে না।

- হ্যাঁ ঠিকই! মাধবির এই অসুখের চক্করে জাহিদের ব্যবসারও অনেক ক্ষতি হয়ে যাবে। ব্যবসায় কোনো মনোযোগই দিতে পারছে না। উপরন্তু পানির মতো করে পয়সা খরচ হয়ে যাচ্ছে। 

- কী যে আছে সামনে! বলতে খারাপ লাগছে কিন্তু তবুও না বলে পারছি না। মাধবির অবস্থা যেদিকে যাচ্ছে তাতে করে জাহিদের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবার সময় এসে গেছে। 

- ভাইয়ার ভবিষ্যত! মানে কোন ভবিষ্যত? 

- আবার বিয়ে-শাদী করে সেটেল করার কথা বলছি আর কি। কীইবা বয়স হয়েছে জাহিদের! তোমরাও এনিয়ে ভাবো।

শ্বশুরবাড়ির লোকজন মাধবির সামনে এসব বলত না। নিলার সামনে বলত। নিলা সব কথার অর্থ বুঝত না। কিন্তু কথাগুলোর নেতিবাচক ভাব 


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ