আরিফ নজরুল
বাংলা কবিতার ইতিহাসে আবুল হাসান (১৯৪৭–১৯৭৫) এক স্বল্পায়ু অথচ গভীর প্রভাবশালী কণ্ঠস্বর, যিনি তাঁর কাব্যে নিয়ে এসেছেন গভীর জীবনবোধ, বিষণ্ণতাজনিত আভিজাত্য, দ্রোহ ও প্রেমের তীব্র, তপ্ত ও সংবেদনশীল চিত্রকল্প। তাঁর কবিতায় আমরা যেমন পাই নিঃসঙ্গতার দর্শন, তেমনি পাই রাষ্ট্র, সময় ও ব্যক্তিগত সম্পর্কের জটিলতা থেকে জন্ম নেওয়া এক আত্মবিকশিত প্রতিবাদ। আবুল হাসানের কবিতার নন্দনতত্ত্ব বিশ্লেষণ করলে চারটি কেন্দ্রীয় অভিজ্ঞান সামনে আসে—শৈল্পিক বিষণ্ণতা, সময়-সচেতন দ্রোহ, প্রেম ও আত্মদ্বন্দ্ব, এবং গভীর প্রতীকময় চিত্রকল্প নির্মাণ।
আবুল হাসানের কবিতার প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো তার অন্তর্লীন বিষণ্ণতা। এই বিষণ্ণতা নিছক হতাশা নয়, বরং এক অভিজাত আত্মবীক্ষণের ফল। তাঁর কবিতা যেন আত্মজৈবনিক মৃত্যুর প্রস্তুতির নিঃশব্দ সঙ্গীত। ‘পাখি হয়ে যায় প্রাণ’ কবিতার শেষে তিনি লেখেন—“পাখি হয়ে যায় এ প্রাণ ঐ কুহেলি মাঠের প্রান্তরে হে দেবদূত!” এখানে মৃত্যুর প্রতিচ্ছবি ফুটে ওঠে “প্রাণ”-এর পাখি হয়ে যাওয়া এবং কুহেলিমাখা মাঠে এক দেবদূতের গান শোনার অভিজ্ঞতায়। মৃত্যু এখানে ভয় নয়, বরং এক নান্দনিক অন্তিমতা—যেখানে নিঃসঙ্গ কবি এক ধ্রুপদী আভিজাত্যে বিলীন হন।
এই বিষাদবোধ আবুল হাসানের আত্মজৈবনিক ইতিহাসের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। অল্প বয়সে হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়া, জীবনের কঠিন বাস্তবতা, একাকিত্ব, রাষ্ট্র ও সমাজের অব্যবস্থাপনার কারণে তাঁর কবিতার স্বর ধীরে ধীরে হয়ে উঠেছে গভীর আত্মসমীক্ষণমূলক। এই উপলব্ধিই তাকে বিষণ্ণতা দিয়েও নির্মাণ করেছে এক অন্তর্লীন সৌন্দর্য। তিনি লিখেছেন—“অবশেষে জেনেছি মানুষ একা! জেনেছি মানুষ তার চিবুকের কাছেও ভীষণ অচেনা ও একা!” এখানে যে একাকিত্ব ফুটে ওঠে তা মানসিক ভঙ্গুরতা নয়, বরং এক আত্মিক উপলব্ধির বহিঃপ্রকাশ।
তাঁর কবিতায় যেমন ব্যক্তিগত বিষাদ, তেমনি রয়েছে সমাজ ও সময়ের বিরুদ্ধে এক সংবেদনশীল প্রতিবাদ। আবুল হাসানের কবিতা শুধুমাত্র ব্যক্তিগত নয়, বরং সেখানে এক রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটও রয়েছে, যা অনুধ্যানযোগ্য। ‘সে এক পাথর আছে কেবলি লাবণ্য ধরে…’ কবিতায় কবি প্রশ্ন তোলেন—“এটা কি পাথর নাকি কোনো নদী? উপগ্রহ? কোনো রাজা? পৃথিবীর তিনভাগ জলের সমান কারো কান্নাভেজা চোখ?” এখানে লাবণ্য, পাথর ও কান্না—সব মিলিয়ে একটি রাষ্ট্রিক, মানবিক এবং অস্তিত্ববাদী প্রতীক নির্মাণ করা হয়েছে, যেখানে কবি প্রশ্ন রাখছেন পরিচিত ইতিহাস ও ক্ষমতার ধারার বিরুদ্ধে।
এই ধরনের সময়-সংবেদী অস্তিত্বচেতনা তাঁকে আধুনিক বাংলা কবিতার গুরুত্বপূর্ণ দ্রোহকবিতে পরিণত করে। তিনি রোমান্টিকতা ও বিপ্লবকে একত্রে মেশাতে পেরেছেন—যা বিরল গুণ। তাঁর ‘যুগলসন্ধি’ কবিতায় প্রেমকে যেমন বিষে জর্জর দেখানো হয়েছে, তেমনি সেই প্রেমের মধ্যেও তিনি রাষ্ট্র, দুর্ভিক্ষ, দেহ, ভাষা এবং সময়ের জটিল বাস্তবতাকে মিশিয়েছেন। কবি লিখেছেন—“থাকুক দু’চোখে দুর্ভিক্ষের দাহ, ঝরুক আবার আন্ধার আধিব্যাধি।” প্রেম এখানে নিছক মানসিক বা শারীরিক আকর্ষণ নয়, বরং এক অস্তিত্ববাদী প্রতিক্রিয়া, যা নাগরিক জীবনের ভেতরকার সংঘাতকে প্রতিফলিত করে।
আবুল হাসানের প্রেমের কবিতা সাধারণ প্রেমিক-প্রেমিকার কথোপকথন নয়, বরং সেখানে রয়েছে দেহ ও আত্মার সংঘাত, কাম ও করুণার দ্বৈরথ। ‘কালো অ্যাসট্রেতে!’ কবিতায় তিনি প্রেমের অপেক্ষা ও অনুপস্থিতিকে নন্দনতাত্ত্বিক উচ্চতায় নিয়ে যান—“তোমার চোখের মতো কয়েকটি চামচ! তোমার হাসির মতো উড়ছে চাইনিজ পর্দা রেস্তোরাঁয়।” এইসব পঙ্ক্তিতে প্রেম এক চিত্রকল্পসম নিদর্শন; কিন্তু তা অনুপস্থিতিক, প্রত্যাশাভঙ্গমূলক। স্বাতী এখানে আসে না—অপেক্ষা, অনুপস্থিতি ও প্রেমহীনতা যেন প্রেমেরই নন্দনশাস্ত্র হয়ে দাঁড়ায়।
![]() |
কবি আবুল হাসান ও সুরাইয়া খানম |
‘যুগলসন্ধি’ কবিতায় প্রেম একেবারে বিষাক্ত অভিজ্ঞতায় রূপ নেয়—“আমাদের প্রেম হোক বিষে জর্জর / সর্পচূড়ায় আমরা তো বাঁধি বাসা।” প্রেম এখানে বিষাক্ত নয়, তা বিষকে ধারণ করে এক অলংকারে রূপান্তরিত হয়েছে। প্রেম হয়ে উঠেছে একটি দহনকালীন সত্য—যেখানে শরীর ও মন অভিসার করে পুড়ে যায়, পবিত্রতার ছায়া নিয়ে।
আবুল হাসানের কাব্যনন্দন গঠিত হয়েছে অভিনব চিত্রকল্প, প্রতীক এবং রূপকের মাধ্যমে। তাঁর কল্পনার জগত কখনো নাগরিক, কখনো লোকজ, আবার কখনো অলৌকিক ও আধিভৌতিক। ‘স্রোতে রাজহাঁস আসছে’ কবিতায় রাজহাঁস প্রতীকে পরিণত হয় সৌন্দর্য, স্মৃতি ও দ্রোহের। “আমরা নৌকার জলে ভাসতে ভাসতে যেন প্রতীকের হাঁস / ঐ রাজহাঁস”—এই চিত্রকল্পে আবুল হাসান বাস্তবতা ও কল্পনাকে একত্রে বাঁধেন। রাজহাঁস এখানে নিছক এক জলজ প্রাণী নয়, বরং তা হয়ে উঠেছে প্রতীকের গতি, দিকচিহ্ন ও পরম গন্তব্যের রূপক।
‘হরিণ’ কবিতায় তিনি লিখেছেন—“তুমি স্তনের কাছে কোমল হরিণ পোষো, / সে-হরিণ একটি হৃদয়।” এই চিত্রকল্প অত্যন্ত সংবেদনশীল, কামুকতা ও কোমলতার এক অসাধারণ সম্মিলন। হরিণ এখানে নারী-দেহের এক নরম অংশে থাকা হৃদয়ের উপমা—যা কবিতাকে করে তোলে simultaneously sensual and philosophical।
আবুল হাসানের কবিতায় আলোর ব্যবহারও এক বিশেষ নন্দনতাত্ত্বিক উপাদান। তাঁর অনেক কবিতায় আলো নিছক আলোকসজ্জা নয়, বরং তা কখনো মৃত্যুর পূর্বাভাস, কখনো প্রেমের মায়া, আবার কখনো স্মৃতির আবেশ। তাঁর আলো-অন্ধকারের দ্বৈতবিন্যাস চিত্রনাট্যর মতো আবর্তিত হয়। ‘স্রোতে রাজহাঁস আসছে’ কবিতায় তিনি বলেন—“আর একটু নত হোক আলো / আর একটু নির্জন হোক অন্ধকার!” এখানে আলো ও অন্ধকার যেন একটি ধ্যানের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব। আলো মানে যদি স্মৃতি, মায়া ও প্রেম হয়; অন্ধকার মানে মৃত্যু, ক্ষয় ও অন্তর্ধান।
![]() |
তিন বন্ধু কবি গোলাম বাসদার সিদ্দিকী, কবি আবুল হাসান ও কবি নূরুল হুদা |
আবুল হাসানের কবিতার আরেকটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তার লোকজ স্মৃতি ও মিথের গীতিকবিতার রূপান্তর। ‘পাখি হয়ে যায় প্রাণ’ কবিতায় উঠে আসে সরজু দিদি, দুলাভাই, লীলা বৌদি, সাইকেল—এইসব চিত্র যেন বাস্তব জীবন থেকে নেওয়া কিন্তু মিথে রূপান্তরিত। তাঁর কবিতা স্মৃতি-নির্মাণের মাধ্যমে এক নান্দনিক গোষ্ঠীচেতনার ধারণা সৃষ্টি করে, যেখানে শহুরে বিষণ্ণতা ও গ্রামীণ অতীত এক অনিবার্যভাবে মিলেমিশে যায়।
আবুল হাসান বাংলা কবিতায় একটি কাব্যিক পরম্পরা রচনা করে গেছেন যেখানে কবিতা আর নিছক ভাষার খেলা নয়, তা হয়ে ওঠে এক নান্দনিক অস্তিত্ব। মৃত্যুচেতনা, প্রেমের নির্মমতা, স্মৃতির সংরাগ, রাষ্ট্রিক বিষণ্ণতা, এবং কামনা-আবেগের দোলাচল—সবকিছু একত্রে এক কাব্যিক মহাকাশ নির্মাণ করেছে। সেই মহাকাশে একজন কবি বসে থাকেন একা, তাঁর চারপাশে বিশজন দেবদূত গেয়ে চলেছে শতজীবনের শত কুহেলি ও কুয়াশার গান।
আবুল হাসানের কবিতা তাই শুধু পাঠ্য নয়—তাকে অনুভব করতে হয় এক নৈঃশব্দ্য, বেদনা ও নন্দনের ভিতর দিয়ে। এই নন্দনই তাঁর কবিতার অন্তর্লীন দর্শন। তা ধ্বনিময়, প্রতীকময়, বিদ্রোহী ও রহস্যময়। আবুল হাসান বাংলা কবিতাকে একদিকে এনে দিয়েছেন দ্রোহের কাব্যিকতা, অন্যদিকে বিষণ্ণতার মধ্যে সৌন্দর্য সন্ধানের এক অপার সংবেদন। তাঁর কবিতা রয়ে গেছে ‘কালো অ্যাসট্রেতে’ ছাই হয়ে, আবার ‘রাজহাঁস’ হয়ে ভেসে চলে গেছে এক অনন্ত গন্তব্যে, যেখানে কবি নিজেই নদী, হরিণ, পাখি, কিংবা বিষমাখা প্রেম।
লেখক : কবি ও প্রকাশক
0 মন্তব্যসমূহ