লন্ডনের চিঠি ৩ : প্রবাসীর খেরোখাতা
প্রবাসী হওয়া মানেই পরিবার থেকে ছিন্ন হয়ে পড়া/হুসনুন নাহার নার্গিস
প্রবাসী হওয়া অর্থই তো নিজের পরিবার থেকে ছিন্ন হয়ে পড়া। আপন মানুষগুলো এক সময় স্বার্থসিদ্ধির জন্য তৎপর হয়ে ওঠে। পেলে ভালো, না পেলে আর আপনজন থাকে না। যেমনটা হয়েছে নিশির ক্ষেত্রে। নিশি ভাবতেই পারেনি পরিবার তার সাথে এরকম দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকের মতো আচরণ করবে।
বিয়ের পরেই নিশিকে চলে যেতে হয়েছে প্রবাসে। যেখানে নেই কোনো পরিচিতজন বা আত্মীয়স্বজন।
নিজের মনেও কথা বলার কেউ নেই। এ যে কতখানি কষ্টের তা শুধু প্রবাসীই বুঝবে। দেশ ফেলে সমাজ ফেলে ভিন্ন এক পরিবেশে থাকতে হবে, নিশি তা জানতো না। মা ভাইবোন সবাইকে একটু দেখার ইচ্ছা, এটা যে কষ্টের তা তারা কেউ বুঝতেই চায় না। একটা দেশ থেকে আর একটা দেশে গিয়ে জীবন আরম্ভ করা, জীবন চালাতে কাজ পাওয়া সবকিছুতে অনেক বাধা, কিন্তু তা বোঝানো যায় না এই মানুষগুলোকে।
নিশি এমন এক পাঁকে পড়ে গেছে তা থেকে বের হওয়া অনেক কষ্টের।
হাতে টাকা পয়সা যা কিছু ছিল সব দিয়ে মাথা গোঁজার একটা আশ্রয় কিনতে হয় তাদেরকে । প্রতিমুহূর্তে পরিবারের সবার মুখ মনে পড়ে। রাতে বিছানায় শুলে শুধু কান্না আসে।
নিশি ও তার হাজবেন্ড দুজনেই বড়ো পরিবার থেকে আসা। সেই সময়ের দরিদ্র বাংলাদেশে কিছুই ছিল না। তিন বছর পর
নিশি দেশে যাওয়ার সুযোগ পায়। কিন্তু প্লেনের ভাড়া কোথায় পাবে? এক বন্ধু ওয়ান ওয়ের প্লেন ভাড়া ধার হিসেবে দেয়। নিশি তার কথা মনে রাখবে সারা জীবন।
কিন্তু হায় এটাই কী তার জন্য অপেক্ষা করছিল? নিশি তার বাবার বাড়ির সবার আক্রোশে পড়ে। প্রধান কারণ সে কেন বিদেশ যাওয়ার সুযোগ পেলো , কেন তারা নয়? এটায় তাদের প্রধান রাগের কারণ।
নবনীতার ডায়েরি সুখ দুঃখ
‘আমি হৃদয়ের কথা বলিতে ব্যাকুল...’। কী কথা নবনীতার? সে কি কোনো গল্প? পাঠক, আমরা নবনীতার কথা তার মুখেই শুনব।
কেন জানি ব্রিটেনের দরিদ্রদের নিয়ে নবনীতার গবেষণা আর লেখালিখি করতে খুব ভালো লাগে। কারণ নিজেও সেই টানাপোড়নের মধ্যে দিয়ে জীবনের অনেকটা পথ পাড়ি দিতে হয়েছে। কী দেশে, কী বিদেশে সবখানেই।
দরিদ্রতার সঙ্গেই তার অনেক ঘনিষ্ঠতা। সেই আফ্রিকার লেখকের কথাটি তার খুব মনে ধরেছেÑ‘দারিদ্র হলো দাহ, যে এর মধ্যে দিয়ে গেছে, সেই জানে এর কষ্ট!’
নবনীতা অনেকগুলো ভাইবোনের বিরাট এক পরিবার থেকে আসা। চাওয়া পাওয়া খুব সীমাবদ্ধতায় আবদ্ধ।
নবনীতা যখন ব্রিটেনে আসে জীবন আরম্ভ করতে হয়েছে যে কাজ পাওয়া গেছে তাই দিয়ে।। যা অনেকেই করে থাকে। ‘প্রয়োজন কোন আইন মানে না’। সপ্তাহে ৪০ ঘণ্টা খাটুনি। বাড়ি এসে নিজ হাতে সব কাজ সামলানো। সোজা কথা নয়।
যে ভাবে জীবন আরম্ভ করতে হয়েছে তা সে আশা করে আসেনি। তাই আশা ভঙ্গের বেদনায় বেগ পেতে হয়েছে। কনফিডেন্স সব চলে গেছে। আবার তা ধীরে ধীরে আসে যখন সে পড়াশুনা আর স্কিল যোগাড় করে চাকরি পায়। নিজের ক্যারিয়ার গোছাতে থাকে। বেশি দিন দরকার হয় না উপরে উঠতে। একবার আরম্ভ করায় কষ্ট। কারণ অভিজ্ঞতা ছাড়া কেউ এখানে কাজে নিবে না। সব কিছুই নবনীতার হয়। এটাই এই দেশের সুবিধা। যেমন হয়েছে অভিজ্ঞতা, চাকান তার সাথে সেই লাইনের উপরে পড়াশুনা আর গবেষণার সুযোগ।
গবেষণা হ্যাঁ গবেষণার কথায় বলছিলাম। দরিদ্র লোকজন আর তাদের জীবন এবং মেয়েদের কষ্ট বা কি ছিল তাদের প্রতিদিনের জীবন তা জানার বিরাট সুযোগ এনে দায় এই গবেষণা করতে গিয়ে।
ভিক্টোরিয়ান আমলে নারী ছিল এখনকার বাংলাদেশের নারীদের মতো জীবন। আর নবনীতার জীবন ছিল বাংলাদেশে থাকা কালীন সময়টা ব্রিটেনের মধ্য যুগের মতো। টাকা ঢাললেও ভালো বাড়ি পাওয়া যেতো না। কয়লা দিয়ে দাঁত পরিষ্কার, শ্যাম্পু নাই, মেথর দিয়ে পায়খানার মল সরানো, কাঠের চুলা, ছাই দিয়ে থালা বাসন পরিষ্কার, পানির লাইন ছিল না, খোলা দুর্গন্ধ ড্রেন, গরুর গাড়ী, গুন টানা নৌকা, মাটির রাস্তা, ইলেকট্রিক ফ্যান ছিল না, হাত পাখা দিয়ে বাতাস, ইঁদারা থেকে দড়ি বালতি দিয়ে পানি তোলা, খাওয়ার আগে শুধু পানি দিয়ে হাত ধোয়া, সাবান দিয়ে নয়। টয়লেট থেকে এসে ছাই দিয়ে হাত ধোয়া, প্রতি বছর কলেরা, টাইফয়েড মহামারি হয়ে দেখা দিত। এই সব ছিল ব্রিটেনে মধ্য যুগে আর ভিক্টোরিয়ান আমলে। আর চিন্তা ধারা ?
আমাদের চিন্তাধারা এখনো আধুনিক হয়নি। যুক্তি দিয়ে মানুষ বিচার করে না। মেয়েরা ঘর বন্দি, ইনকাম করে না ৭০% মেয়ে। মেয়েদের কাজ বাচ্চা উৎপাদন আর রান্না বান্নায় সীমাবদ্ধ। নারী-পুরুষ সমান অধিকার পায় না। সমান ভাবে দেখা হয় না। পুরুষ বাবার সম্পত্তি দ্বিগুণ নায় , খুব ঃৎধফরংধহ মেনে চলে। নারী ডিভোর্স হলে দ্বিতীয় বিয়ে হতে ঝামেলা হয়। মানুষ কানাঘুষা করে। দোষ হয় শুধু মেয়েদের।
নবনীতা ব্রিটেনের নারী নিয়ে কাজ করতে গিয়ে ১৮৮৮ সালের 'জ্যাক দি রিপার' এর যে মেয়েগুলো ভিকটিম হয়ে ছিল তাদের জীবন নিয়ে গবেষণা চালায়। ৩৫% মানুষ ভিক্টোরিয়ান আমলে মানুষ দারিদ্র সীমার নিচে বাস করতো। ১০/১১ জন সন্তানের এক-একটি পরিবার। বার্থ কন্ট্রোল পিল তখনো বের হয়নি।
লাইন ধরে ছেলে মেয়ে এক পরিবারেই, পরনে-ছেড়া ময়লা কাপড়, অপিরিষ্কার চেহারা, কাজ করতে করতে আর সন্তান জন্ম দিতে দিতে জীর্ণ শীর্ন মলিন চেহারার মায়ের। এই ছিল ভিক্টোরিয়ান আমলে দরিদ্র পরিবারের চিত্র। যার সাথে নবনীতার পরিবারের অনেক মিল। শুধু একটা দিক ছাড়া আর তা হলো নবনীতার বাবা সবাইকে ‘পড়াশুনা জীবনের মূল লক্ষ্য’ নির্ধারণ করে দিয়ে ছিলেন; আর এই দরিদ্র ভিক্টোরিয়ান আমলের পরিবারে তা বলার কেউ ছিল না।
আমরা শুধু জানি রানী এলিজাবেথ, প্রিন্সেস ডায়ানা আর বাকিংহাম প্যালেস। জানিস না লন্ডনের ইস্টএন্ডের এই ঘরবাড়ি হীন, ক্ষুদার জ্বালায় জর্জরিত মানুষগুলোর জীবনের গল্প।
চলবে