জন্ম ৬ ডিসেম্বর ১৯৪২; কলকাতার কাঁচড়াপাড়ায়। মৃত্যু ১৭ মে ২০০৩; ঢাকায়। পৈতৃক নিবাস কুমিল্লার মতলব থানার মাদারতলি গ্রামে। ঢাকার জগন্নাথ কলেজ থেকে ১৯৬৫ সালে বিএ পাস করেন।
দেশি-বিদেশি একাধিক প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেছেন। সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন একটি সাপ্তাহিক পত্রিকায়। কিন্তু কোথাও থিতু হননি। ষাটের সাড়া জাগানো সাহিত্যপত্রিকা ‘স্বাক্ষর’-এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক। মূলত কবি। কবিতা, ছড়া ও প্রবন্ধ মিলিয়ে প্রকাশিত গ্রন্থ কুড়িটিরও বেশি। দূরের কার্ণিশ (১৯৭৫); তিন পাপড়ির ফুল (১৯৭৯); পারাবত এই প্রাচীরের শেষ কবিতা (১৯৮২); আমি সেই ইলেকট্রা (১৯৮৫); বহুদিন উপেক্ষায় বহুদিন অন্ধকার (১৯৮৭); পাত্রে তুমি প্রতিদিন জল (১৯৮৭); এক রাত্রি এক ঋতু (১৯৯১); সতত ডানার মানুষ (১৯৯১); কাফকার জামা (১৯৯৪); সুলতা আমার এলসা (১৯৯৪); রুমালের আলো ও অন্যান্য কবিতা (১৯৯৫); লোরকাকে যেদিন ওরা নিয়ে গেলো (১৯৯৭) সিকদার আমিনুল হকের কবিতার বই। এছাড়া শ্রেষ্ঠ কবিতা ও রচনাবলিও প্রকাশিত হয়েছে।
বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি হিসাবে পেয়েছেন একুশে পদক, বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার ও কবি আহসান হাবীব পুরস্কার।
আলাপ
প্রহসনের জ্বলন্ত অঙ্গারে যারা ঘ্রাণ নাওনি
তারা আমাকে জানো না—
প্রতীক্ষায় ছিলো শিশু, জন্ম নেবে রোমশ ঋতু
তারা আমাকে দ্যাখোনি—
হয়তো নীল সমুদ্র, কিন্তু গভীরে ওত পেতে আছে
বর্বরতা…
আমাদের রাত্রি, ভোরের মুখোশে মুসাফির
দাম্ভিক আর নির্লজ্জ;
এই গাছ কতদূর সবুজার্দ্র, নদী গাঢ়তর
হে জীবিত, তোমাদের বলবো না।
নত হও, দেখবে, নত হও, তুমিও দেখবে।
বিষ্ণু দে, এক লাল কমলের স্মৃতি
একদা তোমার সঙ্গে ছিলাম সন্ধ্যায় নিরিবিলি
গৃহস্থের ছোটো ঘরে, অথবা শিল্পিত সারা বিশ্বে
স্বপ্নাবেশে পাশাপাশি। প্রাচীণ গ্রামোফোনে
কখনো সাহানা দেবী আবার কখনো বিথোভেন
দিয়ে গেলো উপভোগ্য অবসর; কিংবা বাস্তবিক
রহস্যের বিপণ্ণতা, শব্দমালা বিস্ময় সত্তায়।
সেদিনই জেনেছি আমি মার্কসের ব্যক্তিত্ব প্রখরতা
আর মমত্বের অর্থ; তোমার চৈতন্যে যে-প্রতীক
আনে স্মিত উর্বরতা, প্রাণের গঙ্গায় লক্ষ প্রাণ—
কী তার বৈশিষ্ট্য আর বিচিত্র সত্তার ডালপালা
কতদূর প্রসারিত। তুমি নও শুধু উপাখ্যান
শিল্প আর বৈদগ্ধের তুমি ছন্দ খোদাই মূর্তিতে।
গোলাম মোহাম্মদ রোডে কষ্ট নেই কলকাতার গ্রীষ্মে!
খোলামেলা গালগল্পে নিজেকে ভীষণ দামী মনে
হতো রাজসিক স্পর্শে; দেখতাম সম্পর্দ ঐশ্বর্য
কত ঝুটা! কেননা এ-ঘর কলকাতার অবান্তর
অংশের সেকেলে প্রতিনিধি; কিন্তু যদি জনান্তিকে
দৃষ্টি দিই, তবে এই মনুষ্যত্ব রাষ্ট্রীয় প্রতীক।
আত্মজীবনীর এক পৃষ্ঠা
এখানে দাঁড়িয়ে আছি রাত বারোটায়। কিছু দূরে
শহরের শেষ অন্ধকার স্থির। আজ আস্তাবলে
ব্রাউন রঙের ঘোড়া সম্ভবত নেই। উট ছিলো
সিরিয়ার পথে পথে; উঁচু বুক নৈশ জানালায়।
বিপ্লব বিব্রত হলে কাফে কিংবা ঝকমকে চাঁদ
নিশ্চিত উগড়ে দেয় মৃত্যুভয় আর মুদ্রাস্ফীতি ঘটে।
তথাপি ভোরেই আসে শাদা রুটি। আজকাল আর
ডিম নয়। শুধু কফি। সাম্প্রতিক বৃষ্টির শহরে
ভোরের পত্রিকা আর বাল্যকাল; প্রৌঢ়ত্বের সাক্ষী
বহুক্ষণ থাকে প্রিয় প্রাতরাশে। পরে ধীরেসুস্থে
রকিং-চেয়ারে বসে গনগনে রোদ, কালো কাক
ভের্লেনের দিনপঞ্জি পড়ে পড়ে দুপুর গড়ায়।
তারপর প্রথামত সিঁয়েস্তায়। দূর থেকে তুমি
কার অন্বেষায় আছো? তুমি কি জানো না এই দেশে
আর নেই চাষবাস; সকলের ইচ্ছা স্বপ্নহীন—
কেবল ভাঁড়ের কিছু কাজ আছে। এক জোচ্চোরের
ধারালো ছুরির নিচে বিহ্বল সুখ্যাতি। বাজপাখি
চোখ শব্দ বন্দি করে। বাকি দিন আলস্যে নৃপতি।
ফলত মর্গের আগে বিশৃঙ্ক্ষলা এখন নিয়তি।
দুর্বিনীত রথী; তাই রাষ্ট্র নয়; মারণাস্ত্র আর
বারুদের ব্যাপারীর পুঁজিবৃদ্ধি পররাষ্ট্রনীতি!
ওদিকে তেরেসা একা; বন্ধুত্বের নিরন্তর ঝুঁকি
কতটা বুঝবে তুমি দূর থেকে? এত দুর্যোগেও
কম কি আমার ভাগ্য? মেঘে-মেঘে পঞ্চাশ ছুঁয়েছি!
আজকাল
নিঃশব্দ আমাকে চায় আজকাল। ফলে রাত্রিবেলা
আমি দুরারোগ্য; আমি সমুদ্রের চেয়ে বিরাটত্বে
কেবল নির্মাণ খুঁজি; যেখানে আমিষ মাছগুলি
দূর নাবিকের মতো প্রহরায়। আর উটগুলি
প্রায়শ ফেলছে ঘাম মরূদ্যানে।… পরিশ্রমী ঘোড়া
মেক্সিকোর যত্নহীন দূর থেকে ধুলো হয়ে আসে;
যাদের রুমালগুলি গুলি ছোড়ে। আধখোলা বুক—
লেসে বাঁধা স্বপ্নপুরী। তাই হত্যা আর রমণের
সফল কাজের পরে মদ খায় তারা । হিংস্র ক্রোধ
চামড়ার থলি মুক্ত করে। অনিদ্র থাকতে হয়
যেহেতু আমাকে চায় এইসব নারকীয় দৃশ্য…
শিকারি কুকুর আর নেকড়ের ডাক? গুঁড়ি-ঘরে
শুভ্র বরফের পাশে দীর্ঘ বার্চগাছ।…ভাঙা স্লেজ
রুমাল করেছে ধন্য ফার-কোটে কবে এককালে;
অথবা জিব্রালটারে তন্বীর কোমরে হাত রেখে
আজ যারা কবরের অলস বাসিন্দা; সেই সব
শীতার্ত লোমশ হাত, নাবিকের প্রমত্ত চোখের
নিরানন্দ ভরাডুবি রোজ দেখি। শুধু পাতা নয়
ঝরার সমস্ত চিত্র, এমনকি বিড়ালের ঘুম,
রুমালের মৃতদেহ,…প্রতিটি অধ্যায় কাছে আসে।
বিড়াল ও মানুষের কবিতা
রাস্তার ওপরেই ওষুধের দোকান। লন্ঠনের নিচে
বসে থাকে একটা লোক। তার চুল শাদা। মুখ অন্ধকার।
আর বয়স বিমর্ষ হওয়ার দিকে। তার চোখ খুব ছোটো।
ঘুম না জাগরণ, কিছুই জানতে চায় না মধ্যরাত্রির ক্রেতা।
একটা বিড়াল ঘুরঘুর করে। দোকানের ভাঙা বোতল আর
মরচে পড়া পেরেকগুলি পর্যন্ত তার খুব চেনা। লোকটার
গন্ধ, ছেঁড়া জুতো, আর ছাতির কাপড়ের সবগুলি ছিদ্র তার
চেনা। খুব নিঃশব্দে সে ঘরটার উত্তর-দক্ষিণ আর পূর্ব-পশ্চিম
প্রদক্ষিণ করে।
লোকটা এত সরু যে, তার সহজে খিদে পায় না। অথচ
অলস আর ভারী। লোকটার কালো রঙ আর বিড়ালের
কালো রঙ প্রায় কাছাকাছি। যদিও দোকানে যারা আসে
তারা ঠিকই চিনতে পারে। একটা বিড়াল। অন্যজন মানুষ।
লোকটা আমিষ ছেড়েছে আট বছর আগে। শাকসবজি
আর ঠান্ডা ভাতে বিড়ালের আয়ু অল্প! তবু সে আছে।
এই ঘরে। সাত বছর আগে তার মা’র মৃত্যুর পর থেকেই।
লোকটা ঠান্ডা-মারা ধরনের লোক। তার ঘরে চিরুনি
পর্যন্ত নেই! লোকে কুকুর-বিড়ালের নাম রাখে! কেবল
এই বিড়ালটারই কোনো নাম নেই!
কবির কিছু ব্যক্তিগত বিশ্বাস
ক্রমশ আমাকে দ্যাখো : সম্রাটের মতো বসে আছি
আমি আজ সব দিকে, সব তর্কে আমি প্রাসঙ্গিক;
এমনকি মহিলারা গল্প করে সমিতির ঘরে—
আমার কবিতা নাকি দূরে নয়, খুবই শারীরিক।
তাই পতাকার নিম্নে রাখা হবে, রাষ্ট্রীয় বাড়িতে…
এবার শীতের শেষে আমি হবো সম্মানিত কবি।
যারা মদ খাও, তারা ছেড়ে আসো, এই দুর্বলতা!
কবিতা কি মদ্য নয়? বিস্মরণে পৌঁছে দেয় অগণন সাকি।
উপেক্ষা দিয়েছে স্বাস্থ্য— যত লিখি তত ক্রমাগত
উঠে যাই অমরত্বে। —মনে পড়ে, সেই অন্ধকার
যখন অচেনা হেঁটে হতাশায় বাড়ি ফিরতাম…
দেখতাম কত সুখী, মোটা হচ্ছে তাদের গৃহিণী।
এখন আমারই স্বপ্নে বাতাসের ফ্রক উড়ে আসে;
তাতে থাকে কর্পূরের গন্ধ— বালিকার অন্ধকার।
এই অন্ধকার
কাটে না আমার চেনা অন্ধকার। রাষ্ট্র মাঝে মাঝে
তার চাল বদলায়, সেই সঙ্গে দেখি মানুষের
উত্থান-পতন আর রাতারাতি নিজস্ব ঠিকানা
বদলের কত ভোজবাজি! যারা সুদূর দক্ষিণে
ছিলো, চলে যায় উত্তরের ঠাট-ঠমকের দিকে।
ছোটো ঝাড়বাতি, রাতারাতি বড়ো হয়। কার্পেটের
কত যে বিচিত্র রঙ ঘরে ঘরে, আর আসবাব
এত ঝকঝকে, যেন পূর্ণিমার চাঁদ। সুপ্রশস্ত
বাগানে দৌড়োয় রোজ অনুগত শাদা খরগোশ।
লম্বা বারান্দায়, পোর্চে, দোল খায় অর্কিডের ঝাড়।
তাদের রয়েছে বহু বৈধ বা অবৈধ একঝাঁক
মদিরার মতো উগ্র দারুণ রূপসী। খায়দায়
গর্বিত-কুচিন্তা করে মালিকের চারপাশে। দেখি,
মোট কথা বদলায় দিন আর ভাগ্যরেখা দ্রুত।
এদিকে আমার ঘরে, কিছু প্রেত নাচানাচি করে
সারা রাত। অচেনা ভাষায় তারা হাসে, গান গায়;
থালার ওপরে থাকে বাসি-রুটি, মরা তেলাপোকা,
চুরুটের ছাই আর চামড়া-ওঠা হরিণের লাফ;
হাড্ডিসার গাছগুলি নাক ঘষে; আমার দেয়াল
এক্ষুনি পড়বে ভেঙে, ব’লে, হাসে বেড়ালের লাশ।
সুঠাম মৎস-নারী নাকি কঙ্কালের মতো মৃদু ফরসা?
— পাই না সঠিক চিত্র। কাঠের জাহাজ থেকে নামে?
নাকি ক্র্যাচ-ভর করে আসে? অর্জুনের গাছ থেকে
বাসা ছেড়ে অনর্থক; উড়ে যায় ভবনের ছাদে।
ভোর হয়। যুক্ত হয় যুক্তি। কল্পনার অবসান।
আগত রাত্রির ভয়ে, সারা দিন একা শুয়ে থাকি!
রাত্রির বিড়াল
রাত্রির বিড়াল কাঁদে, ইদানীং জনশ্রুতি তাই!
কারা যেন কেঁড়ে নেয় মুখ থেকে এক থালা ভাত;
কিছুটা মাছের ঝোল, মাছ নয়, এই তো সংবাদ!
তাতেই জটলা হয়; পরে ক্রন্দনের সমর্থনে।
নক্ষত্রের বৃষ্টি হয়, ট্রেন থামে চমক জাগিয়ে—
ভুতুড়ে জ্যোৎস্না নিয়ে আসে একদল দক্ষ মিস্ত্রি;
সারা রাত কাজ চলে, সারা রাত পিতলের কীর্তি;
মাঝে থাকে লৌহ, টিন, ইস্পাতের সঙ্গে শক্ত কাঠ।
বিশ্বের বিড়াল সব ছায়াবৃত, ফলত সফল।
ভুলক্রমে একদিন কাঁদা যায়, কিন্তু প্রতিদিন
এই স্বেচ্ছাচার কেন ক্রমাগত ডিঙোবে চৌকাঠ
রাত্রির প্রথম লগ্নে, পরি অবিরত ঘটা করে?
শেলী, তুমি দেখোনি আমার দেশ
এ বড়ো আশ্চর্য দেশ, অবাক হইনে আজ তাই
কিছুতেই। সেলুকাস কাছে নেই, প্রশ্নও পুরোনো,
এ কেমন অন্ধকার দেশ, আর কেমন স্তম্ভিত—
অসহ্য যন্ত্রণা পায় প্রশ্নকর্তা আর প্রশ্ন নিজেই।
এখানে বধির মাত্র ফৈয়াজের একনিষ্ঠ শ্রোতা,
এখানে অন্ধেরা নাকি দূরদ্রষ্টা গলিত সমাজে;
যাদের মাস্তুল দীর্ঘ, তাদের ইঙ্গিতে নীলাকাশে
ঝিমোয় বিমর্ষ রৌদ্র, ঝড় ওঠে সুনীল দুপুরে।
টিভিতে তাঁরাই বক্তা, রেডিওর নব ঘোরালেই
দেখা যায় তাঁরা স্থায়ী, আমাদের ক্ষণস্থায়ী সব
তাঁরা আছে তাই দেশ, তাঁরা রুদ্ধ, সমস্ত শ্মশান—
তারা আজ দেবতুল্য, তুমি শুধু জনসাধারণ।
অবাক হইনে তাই, যদি দেখি প্রকাশ্য নিলামে
গরিষ্ঠরা হেরে যায়; যদি দেখি ইঁদারার ব্যাঙ
মুহূর্তে পেরিয়ে যায় স্তব্ধ জল, সমুদ্রে লাফায়—
পলাতক ফিরে এসে প্রায়শই উঁচু করে মাথা,
যেহেতু সত্বর ঘটে এই দেশে মুখোশের রঙ।
সবাই মঙ্গল চায়, এমনকি সেও আজ চায়!
ব্রাত্য আজ কেউ নয়, একাকার কাদা ও ঝরনায়;
যে-হতো কেরানি কিংবা আপিসের কনিষ্ঠ সাহেব
তাঁর ডাকে আজকাল সূর্যোদয়, সূর্যাস্ত সম্ভব!
কে বলে অযত্নে ফুল, আর কত প্রতিভার মৃত্যু
ঘটে গেছে বারবার! শেলী, তুমি নিতান্ত সাবেকি
দেখোনি আমার দেশ, মনীষা— আলোক যার আছে
তাঁর ঘরে কুঁপি জ্বলে, অতিমূর্খ এখানে সবাক।
সেলুনে একটি লোক
একটি সেলুনে দেখি একজন লোক প্রতিদিন
অপ্রস্তুত বসে থাকে বহুক্ষণ। দৃষ্টি আয়নায়।
এরকম দেখা যায় ধু-ধু লোক সস্তার সেলুনে।
মুখের সাবান তার উড়ে গেছে ক্ষুরের আঘাতে
অতএব ভাঙা মুখ এখন প্রকট! আয়নায়
কী যে দ্যাখে! মুখ নয় সম্রাটের মতো; আর ভাঁড়ও
ফুলো-গাল হয় জানি সার্কাসের! তবে কি অতীত
ভাবনা বিন্যাস করে নিজ হাতে? একটি কিশোরী
অবেলা পুকুরপাড়ে দয়া করে প্রথম কৈশোরে
নিয়েছিলো এই মুখ নিজ হাতে। চাপাচাপি করে
একটি চুম্বন পেয়ে সাত দিন উড়েছে আকাশে।
অনেক কথাই তার মনে পড়ে। চৌকো আয়নায়
দেখে তার শাদা চুল, চিমসে মুখটা অবিকল
বাড়ির দালাল কিংবা ধূর্ত চোরাচালানির মতো!
কিন্তু কেন ভুলে যায়, প্রিয় সেই বাইজির কথা!
আতর উড়তো যার দেহ থেকে; তার কাছে গেলে
সহস্র চুমোয় ভরে যেতো এই মুখ। আর আজ
সব অনটন যেন এই মুখে, তাই কি বিব্রত?
সবকিছুর নিজস্ব প্লাতেরো…
হাঁসগুলি শাদা আর আমার কল্পনা পবিত্র এবং অবশ্যই কার্পাসের মতো শুভ্র!…আমার যদি কোনো প্লাতেরো থাকতো তবে তাকে নিশ্চিতই দেখতাম।
ধরো, যদি থাকতো আমার একজন প্লাতেরো; আর আমি বর্ণনা নিপুণ, তবু কি সবকিছু দেখা যেতো, যেমনটি আমি দেখি?…বা ভাবি যেমনটা আমি দেখছি? মৃত্যু আর সমস্ত বিলীন হবার আগে কিছুই তবে জানবার নেই!
উপভোগ করা কি প্রকৃত দেখার নিকটবর্তী? কে আর কবে নিজের নারীর স্তন, নরম আব্রু আলোর নিচে দেখেছে অবিকল সমগ্রতায়! তুঙ্গ মুহূর্তের ক্রোধ আর উচ্ছ্বাসবর্জিত দেখা, সে কেবল ঈশ্বরের আর আমাদের মৃত্যুর পরে। হয়তো স্নায়ুর একটি বিরাট আঘাত আর পতনের ক্ষণিক মুহূর্ত মাত্রের অতি বিশালতায়।
দেখার ফাঁকগুলো পথচলার সময় আমি অভিজ্ঞতা দিয়ে যথাসাধ্য পূরণ করতে করতে চলবো; আর প্লাতেরো তুমি— পশুর উপলব্ধি দিয়ে আমার প্রতারণায় মৃদু মৃদু হাসবে!
জানো তো প্লাতেরো, বোকামি আর নির্বুদ্ধিতার জন্যে পশু কেন, একজন গোবেচারা গাছেরও হাসি পায়!…
হাওয়ার একটি সন্ধ্যা…
হাওয়ায় একটি সন্ধ্যা ছাড়া কোনো স্বাধীনতা আমাদের নেই। ঘরের বাইরে আমাদের নির্দেশ, অবাধ্যের জন্যে তাক করে বেয়নেট— শুধু ঘরের ভেতরে নিজের কবিতা উচ্চারণ করার অন্ধকার সিঁড়ি।
কাফকা আর প্রুস্তের গ্রন্থগুলি পড়েছি; সেই থেকে আমাদের বন্ধ জানালায় ধুলো আর অতি গর্বিত মাকড়সার জাল। গ্রিক নাটকগুলি পশুত্বের মিথুন আর রক্তগৌরবের বিশাল চিৎকার। স্বাধীনতা, ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে কী রকম ছিলো, আমরা তা কখনোই স্পষ্ট করে বলতে পারবো না।
তবু হাওয়ার রাতে চাঁদের দিকে তাকিয়ে থাকার সম্ভাবনা তীর্থযাত্রীদের জন্যে এখনো সম্ভব। সমুদ্রের ফসফরাস স্পর্শ করা ছোট বাড়িগুলির ওপর অশান্ত পাখিদের শাদা বা বাদামি পালকের দিকে তাকিয়ে থাকা প্রেমিক-দম্পতি এখন মাধুর্যের কিছু কথা সংগমের অভিলাষ ছাড়াই বলতে পারে। তারা ধর্মের জটিলতার সামনে এখনো সশ্রদ্ধ কিছু খেইহারা।
দেবদারু গাছ মাথা নাড়ে। তারা সাড়া দেয়। সমুদ্রের টাটকা মাছ ও ফলের অপরাধ ভুলে গিয়ে খাবার টেবিলের নীল টেবিলক্লথের ওপর মদের গ্লাস নিঃসংশয়ে ঢেলে দিয়ে আদিম গুহা মানবের মতো খুশিতে চিৎকার করে।
পরে তারাই বারান্দায় জড়ো হয়। স্বাধীনতার কথা বলতে চায়, অথবা লাতিন আমেরিকার স্বৈরতন্ত্রের শেষ কাপুরুষটির খুন করবার ধরন-ধারণ ও কর্কশ ছুরির আকার ও তার (শাসকের) ছেলেবেলার শিশ্ন ব্যবহারের রসাল গল্প বলতে বলতে রাত্রির তৃতীয় যামে চাঁদের দিকে তাকিয়ে নিজেদের পরিচয় ভুলে ক্লান্তির হাই তোলে।
0 মন্তব্যসমূহ